Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

33kএম আবদুল হাফিজ । খােলা বাজার২৪।। বৃহস্পতিবার , ১১ মে, ২০১৭: বিগত নভেম্বরে নির্বাচনী বিজয়ের আগেই সম্ভাব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের রাজধানীগুলোয় প্রচণ্ড স্নায়বিক কম্পনের উত্পত্তি ঘটান, যখন তিনি ব্রেক্সিট-প্রক্রিয়া সমর্থন দেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সমালোচনা করেন এবং নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, যাকে তিনি সম্প্রতি অচল ঘোষণা করেছেন—তা থেকে তাঁর দেশকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের এক ধরনের ছিনালিপনা (flirtation) ইউরোপীয় নেতাদের হতভম্ব করেছে, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক রাষ্ট্রপুঞ্জকে।

আগে কখনো বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির সময় পর্যন্ত একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী (পরে নির্বাচিত) মার্কিন-ইউরোপ সখ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বা ক্রেমলিনের নেতাকে তোষামোদ করেছেন। এসবই সম্ভব এখন, যেন ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো স্বাভাবিক সত্তা নন।

মজার কথা যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পের মধ্যকার পার্থক্য সামান্যই। একটু সময় লাগলেও বিষয়টি এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তাই নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বুঝতে আর কষ্ট হয় না এখন। ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি প্রচারাভিযানের ঘোষণা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন মেক্সিকোর সীমান্ত বরাবর প্রাচীর নির্মাণে এবং সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের পর্যটক ও উদ্বাস্তুদের তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ (TPP) থেকে গুটিয়ে নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।

মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষিদ্ধকরণসংক্রান্ত ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশকে অনেকে অসাংবিধানিক বিধায় বেআইনি ভাবছেন। তবে এই নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়নে শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয়। এ মুহূর্তে তা অগ্রাধিকার গণমাধ্যম ও তার নিন্দুকদের মুখোমুখি হওয়া। খেপাটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে—তাঁর কাজের সমালোচকরা—তা তাঁরা তাঁর দলের হলেও তিনি তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর।

সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত হোয়াইট হাউসের মেহমান হিসেবে সর্বপ্রথম ওয়াশিংটন সফরে এসেছিলেন। এখানেও তিনি ব্রেক্সিট গণভোটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে আরো ইইউ সদস্য ইইউ ত্যাগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুগামী হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ট্রাম্পের ইইউ সমালোচনা সংগত কারণে ইউরোপীয়রা ভালোভাবে নেয়নি। বলাবাহুল্য ইইউ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূমিকায় সম্ভবত অসন্তুষ্ট হয়েই তাঁকে রাশিয়া ও চীনের দলভুক্ত আখ্যায়িত করেছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইইউয়ের র‍্যাডিক্যাল ইসলামের সঙ্গেও সংযোগের অভিযোগ আছে। এমন সংযোগের বিরুদ্ধে ট্রাম্প দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন। এদিকে ইইউতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হতে যাচ্ছেন ট্রাম্পের মনোনীত থিওডর রুজভেল্ট ম্যালোচ, যিনি বিবিসিকে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন যে তিনি ট্রাম্পের মতো এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অপছন্দ করেন।

ইউরোপীয় নেতাদের ট্রাম্পকে ভয়ের যথার্থ কারণ আছে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের শীর্ষ সামরিক, জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দৃঢ় আস্থা সত্ত্বেও তিনি ন্যাটো বা ইইউয়ের কৌশলগত মূল্যায়ন করতে সক্ষম। বহির্বিশ্বে এ সংস্থাগুলো যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও কত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বা কত মূল্যবান সম্পদ তিনি তা-ও বুঝতে অপারগ। ট্রাম্প তাঁর অরাজনৈতিক ব্যবসায়ীসুলভ প্রাক-আলোচনা উষ্ণতা সৃষ্টিতে নিছক ছলাকলাহীন। ফলে এই অপারগতার মূল্য তাঁকে গুনতে হবে, মার্কিন অর্থনীতির জন্য যা অপচয়। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ইউরোপীয় দেশগুলোও যথেষ্ট ধনী তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বহনে। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় দেশগুলোকে অথবা দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে নিজের অর্থ ব্যয়ে সেখানকার মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে নিজস্ব সেনা মোতায়েন রেখে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল আশ্চর্য হলেও সবেমাত্র বিকশিত হতে শুরু করে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নব্য রক্ষণশীল হস্তক্ষেপে এবং ব্যয়বহুল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তিনি বিজিত দেশগুলোতে মার্কিন মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছিলেন। তবে তাঁর উত্তরসূরি বারাক ওবামা তাঁর মেয়াদে বৈদেশিক নীতির চ্যালেঞ্জকে আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও কোয়ালিশনের মাধ্যমে মোকাবেলা করেছিলেন; কিন্তু ট্রাম্পের জাতিসংঘ সম্পর্কে ধারণা উজ্জ্বল নয়। তাঁর প্রশাসন এরই মধ্যে জাতিসংঘে এবং তাঁর বিভিন্ন এজেন্সিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রদেয় ফান্ডে বড় রকমের বিয়োজনে ব্যস্ত। ট্রাম্প নিজেকে একজন বাস্তববাদী বলে ভাবতে ভালোবাসেন। ট্রাম্প মনে করেন, তিনি সেই ব্যক্তি যিনি দুনিয়াটাকে একজন রাজনীতিক, সেনাধ্যক্ষ বা পেশাদার কূটনীতিকের চেয়ে ভালো বোঝেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন তার আশু জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষা প্রদান এবং অন্যের স্বার্থের সংরক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না এমনটাই ট্রাম্প মনে করেন। তিনি যখন ‘আমেরিকা ফার্স্বে’ কথা বলেন—এভাবেই সেটাকে বুঝতে হবে।

তবে যখন কোনো সংকটের প্রশ্ন ওঠে, যা মার্কিন স্বার্থের প্রতি কোনো হুমকি নয়, ট্রাম্পের অভিমতে সে পরিস্থিতিতে তাঁর দেশ চাইলে নিরপেক্ষতার (irolationist) নীতি গ্রহণ করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেনে রুশ অনাসৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে না জড়িয়ে নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছে।

ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ইইউ একটি দুর্বল সত্তা, অকেজো (dyrfunctional) এবং অরক্ষিত। ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফল এবং তাঁর অভাবিত বিজয় সারা ইউরোপে জনতুষ্টিবাদকে উসকে দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে ডানপন্থী দলগুলোকে, যার বেশির ভাগই ইইউ ছাড়ার পক্ষপাতী এমনই মনে করেন ট্রাম্প। তারা অভিবাসনবিরোধী ও ইসলাম নিয়ে আতঙ্কিত (Islamphobe)।

তবে এই সময়ের জন্য ইইউয়ের প্রতিটি হুমকি অভ্যন্তরীণ। ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি (যারা ২৮ জাতি সংস্থা ইইউয়েরও সদস্য) দেশের নির্বাচনী ফলাফলই বলে দেবে ইউরোপের ভবিষ্যৎ গন্তব্যের ধারা।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস