Fri. Mar 14th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

15খােলা বাজার২৪।। সোমবার , ১৫ মে, ২০১৭:

রেজানুর রহমান

আসাদুল ইসলাম তাঁর জিগাতলার বাসার সামনে অস্থির পায়চারি করছেন। এটা তাঁর নিজের বাসা নয়, ভাড়া বাসা। তৃতীয় তলার ডানদিকের ফ্ল্যাটে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে থাকেন। এক ছেলে-এক মেয়ে। ছেলের নাম তমাল। এবার এসএসসি পাস করেছে। মেয়ের নাম হোসনে আরা মিতু। গুলশানের একটা বেসরকারি কম্পানিতে রিসেপশনিস্ট পদে চাকরি করে। রোজ রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বাসায় ফেরে। এখন রাত ১০টা বাজে, অথচ মিতুর দেখা নেই। কী হলো মেয়েটার? কোনো ঝামেলায় পড়েনি তো! বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিশেষ রিপোর্ট কেন যেন বারবার আসাদ সাহেবকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। পত্রিকায় দুটি মেয়েকে নিয়ে ধর্ষণসংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ভয়াবহ রিপোর্ট। দুই মেয়ে রাজধানীর দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে ২৮ মার্চ ২০১৭। যে এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তার সঙ্গে এর আগে দুই মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাদেরই এক পুরনো বন্ধু। বনানীর একটি চারতারা হোটেলে নিজের জন্মদিনের পার্টিতে ওই দুই মেয়েকে অনেক অনুরোধ করে নিয়ে আসা হয়। ওই হোটেলে নাকি আগে থেকে দুটি রুম ভাড়া করা ছিল। জন্মদিনের পার্টি শেষে দুই মেয়েকে মূল অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার সঙ্গীরা কৌশলে হোটেলের ভাড়া করা দুটি কক্ষে আটকে ফেলে। প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার এক সঙ্গী ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে ছিল মূল অভিযুক্তের দেহরক্ষী ও গাড়িচালক। তারা নাকি দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করেছে। কী বীভৎস! কী নিষ্ঠুর! ঘামতে শুরু করেছেন আসাদুল ইসলাম। শুধুই অশুভ চিন্তা হচ্ছে। মিতু কোনো বিপদে পড়েনি তো? মিতুর মোবাইল ফোনে আবারও রিং দিলেন। ফোন বন্ধ। এবার আরো জোরে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তাহলে কি সত্যি সত্যি মিতু বিপদে পড়েছে? বিপদটা কতটা ভয়াবহ? পত্রিকার খবরে পড়া অসহায় দুই মেয়ের মতো নয়তো! ভাবতে গিয়ে নিজেই নিজেকে আশ্বস্ত করলেন আসাদ। না না, মিতু এ ধরনের কোনো বিপদে পড়তে পারে না। মিতুর বন্ধুরা অনেক ভালো। একজনের নাম চয়ন। আরেকজনের নাম শিবলী। অন্যজনের নাম সামসাদ। ওরা সবাই ভদ্র ছেলে। আসাদের সঙ্গে দেখা হলে ‘আংকেল’ কেমন আছেন? শরীর ভালো তো? এতটাই ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে যে প্রাণ ছুঁয়ে যায়। না না, এ ধরনের ভদ্র ছেলেরা মিতুর কোনো সর্বনাশ করতে পারে না। কিন্তু বাসায় ফিরতে মিতুর দেরি হচ্ছে কেন? ডান হাতের দুই আঙুল অনামিকা আর মধ্যমা সামনে তুলে ধরলেন। যাকেই সামনে পাবেন তাকেই একটা আঙুল ধরতে বলবেন। অনামিকা ধরলে মিতু ভালো আছে। আর যদি মধ্যমা ধরে তাহলে বুঝতে হবে মিতুর বিপদ হয়েছে।

বাসার মূল গেটে উঁকি দিলেন আসাদ। মনে মনে চাইছিলেন বাড়ির মালিক গফুরের সঙ্গে যেন দেখা না হয়। দেখা হলেই নানা কথা জিজ্ঞাসা করবেন। আর যদি জানতে পারেন যে মিতু এত রাতেও বাসায় ফেরেনি তাহলে নির্ঘাত আসাদকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন—না না আসাদ সাহেব, এটা অন্যায়। মেয়েদের এত স্বাধীনতা দিতে নেই। স্বাধীনতার নামে মেয়েরা কী না করছে আজকাল? যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। গফুর সাহেবের সঙ্গেই দেখা হলো। বাইরে থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরছিলেন গফুর। আসাদকে দেখে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার কী? আপনি এত রাতে বাসার গেটে পায়চারি করতেছেন? মেয়ে কি বাসায় ফিরে নাই?

আসাদ ভাবলেন মেয়ের কথা একদমই তুলবেন না। প্রচণ্ড গরম পড়েছে তাই হাওয়া খেতে বাসার সামনে পায়চারি করছেন অথবা এই জাতীয় কিছু বলবেন বলে ভাবলেন। পরক্ষণেই মনে হলো মেয়ের কথা গোপন করা ঠিক হবে না। কথায় আছে ডাক্তার, পুলিশ, উকিল, মোক্তারের কাছে সত্য গোপন করতে নেই। কথাটা বাড়িওয়ালার বেলায়ও খাটে। ধরা যাক মিতু শেষ পর্যন্ত একটা ঝামেলায় পড়েছে। ব্যাপারটা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াল। পুলিশ এসেই প্রথমে বাড়িওয়ালাকে খুঁজবে। বলেন তো আপনার ভাড়াটে কি যেন নাম…

গফুর এবার অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, আসাদ সাহেব, আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছি? মেয়ে কি বাসায় ফিরে নাই? না, অসহায়ের মতো জবাব দিলেন আসাদ। নেতিবাচক আলোচনার একটা মোক্ষম সাবজেক্ট পেয়েছেন এমন উৎসাহে বাড়িওয়ালা গফুর হঠাৎ গর্জে উঠলেন, কতবার বলেছি মেয়ে বড় হয়েছে এবার তার বিয়ে দিয়ে দেন। আপনি তো ভাই আমার কথা মোটেই পাত্তা দেন না। রাত প্রায় ১১টা বাজতে চলল মেয়ে এখনো বাসায় ফিরে নাই। দিনকাল তো ভালো নারে ভাই। বনানীর হোটেলের ব্যাপারটা তো জানেন? মারাত্মক ঘটনা। বন্ধুত্বের কথা বলে ডেকে নিয়ে সারা রাত ধর্ষণ করেছে। ড্রাইভারকে দিয়ে ধর্ষণ দৃশ্যের ছবি তুলেছে। চিন্তা করেন, এরা কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে? না, পড়ে না। এরা নরকের কীট। বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন গফুর। আসাদের মনে হলো বাড়িওয়ালার বকবকানি থেকে এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। কিন্তু মিতু ফিরছে না কেন? সে কি সত্যি সত্যি বিপদে পড়েছে। তার কোনো বন্ধু কি তাকে ডেকে নিয়ে… অমঙ্গল আশঙ্কায় আবার বুকের ভেতরটা ‘ছ্যাৎ’ করে উঠল আসাদের। মিতু… মা মিতু… মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পথে নামলেন তিনি।

দুই.

এ এক আজব শহর। রাত দুপুরেও রাস্তায় এত ভিড় যে হাঁটাচলা করাই মুশকিল। জিগাতলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে কারওয়ান বাজারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন আসাদুল ইসলাম। এত রাতে কারওয়ান বাজারের দিকেই বা কেন এলেন বুঝতে পারছেন না। মেয়েকে খুঁজতে বাসা থেকে বেরিয়েছেন। কিন্তু কারওয়ান বাজারের দিকে এলেন কেন? খুব তেষ্টা পেয়েছে। ফুটপাত ঘেঁষে একটা ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চ দখল করে পাঁচ-সাতজন কামলা টাইপের মানুষ চা খাচ্ছে। দোকানের সামনে রাখা পানির জার থেকে নিজেই পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন আসাদ। মোবাইলে রিং হচ্ছে। বাসা থেকে স্ত্রী পিয়ারী ফোন দিয়েছে। নিশ্চয়ই কোনো সুখবর আছে। তড়িঘড়ি ফোন রিসিভ করলেন আসাদ—হ্যালো… পিয়ারী উত্কণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলেন, তুমি এখন কোথায়? নিজের অবস্থানের কথা না জানিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন আসাদ, মিতু ফিরেছে? পিয়ারী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, না, এখনো ফিরে নাই।

স্ত্রীর কান্না শুনে অস্থির লাগছে। ফোন কেটে দিলেন আসাদ। চায়ের দোকানের সামনে দুজন মানুষ তর্ক জুড়ে দিয়েছে। প্রথমজন বলছে, আপনি কাগজ-কলম আনেন আমি লেইখ্যা দেই বনানীর হোটেলে দুই মেয়েরে যারা ‘রেপ’ করেছে তাদের কারোই সাজা হইব না। দ্বিতীয়জন প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল, আমিও আপনারে চ্যালেঞ্জ করতেছি, আইজ হউক, কাইল হউক ধর্ষকের সাজা হবেই হবে। আসাদ দেখলেন বিষয়টি নিয়ে দুটি পক্ষ তর্কে লিপ্ত হয়েছে। একটা পর্যায়ে তর্কের ডালপালা কয়েক দিন আগে গাজীপুরে রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে বাবা আর মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় ছড়িয়ে গেল। এক পক্ষের হয়ে বাবরি দোলানো এক তরুণ বলল, আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা আর প্রচার মাধ্যমের খবর বলতেছে গাজীপুরে অবুঝ একটি শিশুকে বখাটেরা নির্যাতন করত। এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের এক সন্তান অবুঝ শিশুটিকে সাইকেলে উঠিয়ে জঙ্গলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তার পা কেটে যায়। অথচ পুলিশ বলতেছে, শিশুটিকে নির্যাতনের কোনো আলামত পাওয়া যায় নাই। বনানীর ঘটনাও হয়তো এভাবে দেখানোর চেষ্টা করবে পুলিশ। ট্যাকা থাকলে সব হয়রে ভাই। আসল কথা হইল ট্যাকা।

তর্ক চলছেই। আসাদের মনে হলো, এখন তাঁর বাড়ি ফেরা দরকার। এখন তো রাত। দিনের আলো ফুটলে নিশ্চয়ই আশার আলোও ফুটবে। কিন্তু মিতু গেল কোথায়? হঠাৎ সবার সামনেই মিতু… ও মিতু… মা মিতু… বলে ডাক দিলেন আসাদ। তর্ক করা লোকগুলো চমকে উঠল। তর্ক থেমে গেছে। কেউ একজন আসাদের দিকে তাকিয়ে বলল, পুরান পাগলে ভাত পায় না আইছে নতুন পাগল…

তিন.

হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন আসছে। আসাদ চমকে উঠলেন। তাঁর বাসার পথে তো রেললাইন পড়ার কথা নয়। আশপাশে তাকিয়ে বুঝলেন, কারওয়ান বাজার থেকে ঝিগাতলার দিকে না গিয়ে তিনি মগবাজারের দিকে হাঁটা দিয়েছেন। সেটা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু রেললাইন ধরে হাঁটছেন কেন? ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে বারবার হুইসেল বাজানো হচ্ছে। তবু রেললাইন থেকে সরছেন না আসাদ। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলেন তিনি। পাগলা কিসিমের একটা লোক ছোট্ট একটা মেয়ের হাত ধরে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ ধমক দিলেন, অ্যাই আপনারা কে? এভাবে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পাগলা কিসিমের লোকটি মৃদু হেসে বলল, আমাদের তো আপনার চেনার কথা। পত্রপত্রিকা-টিভিতে আমাদের ছবি দেখেন নাই? গাজীপুরে রেললাইনের পাশে মৃত অবস্থায় শুইয়া আছি। দেশের অনেক পত্রিকায় আমাদের ছবি ছাপা হইছে। টিভিতে তো প্রতিদিনই আমাদের ছবি দেখায়। রেললাইনের পাশে শুইয়া আছি… আসাদ অবাক হয়ে বললেন, অ্যাই আপনারা তো মৃত। কথা বলতেছেন কিভাবে?

লোকটি আসাদকে বলল, আপনিও তো মৃত। এই মাত্র আপনার মৃত্যু হয়েছে। আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। চলেন…

না… বলে চিত্কার দিলেন আসাদুল ইসলাম। অল্পের জন্য ট্রেনের নিচে চাপা পড়েননি। তাঁর চিত্কার শুনে আশপাশের লোকজন ছুটে এলো। কী হইছে ভাই… এভাবে চিত্কার দিলেন কেন?

আসাদ বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে, নাম মিতু, রাতে বাসায় ফিরে নাই। তাকে খুঁজতে বাইর হইছি… মিতু.. মা মিতু… মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলেন আসাদ।

প্রিয় পাঠক, কল্পনা করুন তো মিতু কোথায় যেতে পারে? বন্ধুর বাসায়? তাহলে ফোন বন্ধ কেন? নাকি সে কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছে? আসাদুল ইসলামের কি উচিত বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করা? সেখানেও যদি মিতুকে না পাওয়া যায়? কী বললেন? বন্ধুর জন্মদিনে হোটেলের কোনো পার্টিতে… সর্বনাশ! মিতু তো সত্যি সত্যি বিপদে পড়েছে! কে তাকে উদ্ধার করবে? কে…?

লেখক : সাংবাদিক