এ এম এম শওকত আলী। খােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার , ১৬ মে, ২০১৭: জানা গেছে যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ৫০তম বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ২০২৪ সালের পর এ দেশে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ দরিদ্র ব্যক্তি থাকবে না। তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলা হয়েছে যে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ দরিদ্র ব্যক্তি থাকতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছে শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা। তবে এ ধরনের আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি শর্তসাপেক্ষ। এর জন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে উন্নতির প্রয়োজন। এগুলো হলো—জীবিকার সুযোগ, শ্রমিকদের উত্পাদনক্ষমতা বৃদ্ধি, যা বর্তমানে দৃশ্যমান নয়। এর অর্থ হলো, আমাদের আরো পরিশ্রমী হতে হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে উন্নতির সূচকসংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যানও দৃশ্যমান ছিল। এর মধ্যে প্রধান সূচক ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ১। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল অংশগুলো ৭ মে একটি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়।
এর আগে গত এপ্রিলের ২০ তারিখে কিছুটা বিপরীতধর্মী চিত্র সিপিডির চেয়ারম্যানের বক্তব্যে পাওয়া যায়। তিনি আয়ের অসমতা দূর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, এর জন্য দুটি ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে। এক. সব ধরনের শ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মালিকানায় অংশীদার করা এবং দুই. একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী কৃষিজমিসংক্রান্ত বিষয়ের সংস্কার। শেষোক্ত বিষয়ের জন্য তিনি একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য হবে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা। সংস্কারের অন্যান্য উদ্দেশ্য হবে, শিক্ষার মান বৃদ্ধিসহ নির্বাচনপদ্ধতির সংস্কার। এ অর্থনীতিবিদের মতে, এসব ক্ষেত্রে সংস্কার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা দূর করার প্রধান উপায়। তিনি সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশীয় দেশের বিরাজমান অসম ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার রাজনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণেও টেকসই। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নতিবিষয়ক পদক্ষেপের—যথা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী দারিদ্র্য নিরসনে সফলতা অর্জন করেছে। এ সত্ত্বেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতার সমস্যা রয়েই গেছে এবং দিন দিন অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য যে এ দেশের অন্য অর্থনীতিবিদরাও সম্পদের অসমতার বিষয় অতীতে উল্লেখ করেছেন।
ভূমি ও কৃষিজমিবিষয়ক সংস্কারের ওপর অনেক দিন পর কিছু কথা জানা গেল। এ ক্ষেত্রে সংস্কারের অতীত ইতিহাস আশাব্যঞ্জক নয়—এ কথা কারো অজানা নয়। গত চল্লিশের দশকের শেষের দিকেই এসংক্রান্ত বিষয়ে ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এসংক্রান্ত যে কমিশন গঠন কর হয়, তার নাম ছিল ফ্লাউড কমিশন। এ কমিশনের প্রধান সুপারিশ ছিল (এক) জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং (দুই) বর্গাদারদের অধিকার সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা। ওই সময় এ দুটি সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো সুফল আসেনি। বর্গাদারদের অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত বিলকে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দল এবং বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিরোধিতার ফলে স্থগিত করা হয়। ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে সামাজিক শক্তিগুলো কী পরিমাণ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে? এর বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রশাসনিক কার্যক্রম কতটুকু সুষ্ঠু ছিল অথবা ত্রুটিপূর্ণ ছিল, যার জন্য এর বাস্তবায়ন ব্যর্থ হয়।
ভূমিনীতি সম্পর্কিত বিষয়ে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল ছিল নিষ্ফলা। এ মতও পোষণ করা যেতে পারে যে এটা ছিল ধনী জোতদারদের জন্য ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বৃদ্ধিকরণের কাল। এ সময়ে সর্বোচ্চ সীমা ৩৩.৩ একর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২৫ একরে নির্ধারিত হয়। একইভাবে এটা ছিল এমন এক সময়, যখন গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত এবং কর্মসংস্থান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সময়কাল ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ফলা, ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা দ্বারা আক্রান্ত। যার ফলে বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ এবং আইনি পরিমাণবহির্ভূত জমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এ ব্যর্থতার কারণ রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব ও ত্রুটিযুক্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা। অন্যদিকে বর্গাদারদের অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক আইন ১৯৮৪ সালে প্রণীত হয়। এ আইনে তেভাগানীতি প্রতিফলিত করা হয়েছিল। বর্গা চাষভুক্ত জমির উত্পন্ন ফসল আইনে ভাগ করা হয় : ১. ভূমির মালিক পাবে এক-তৃতীয়াংশ, ২. বর্গাদার পাবে এক-তৃতীয়াংশ এবং ৩. এক-তৃতীয়াংশ পাবে মালিক অথবা বর্গাদার অথবা উভয়েই। শ্রমের বাইরে উত্পাদন খরচের জন্য।
বলা বাহুল্য যে বর্গাদারদের অধিকার আইনে স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে সব সরকারই উদাসীন ছিল। এ ছাড়া ছিল মূল আইনের কিছু জটিলতা। এ আইন প্রণীত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কৃষি মজুরদের মজুরি নির্ধারণ করার বিষয়ে অন্য একটি আইন করা হয়েছিল। এর আওতায় কৃষি মজুরদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে তিন কেজি চাল নির্ধারণ করা হয়। এ আইনও সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ভূমি অধিকারসংক্রান্ত সংস্কার পর্যালোচনা করলে সহজেই জানা যায় যে একমাত্র আইন করেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য যে ১৯৮৪ সালের পর এ ক্ষেত্রে নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এর পর থেকেই ভূমি অধিকারের, বিশেষ করে চাষযোগ্য জমিসংক্রান্ত বিষয়টি মালিক ও চাষিদের ওপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। নতুন করে এ ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হলে এসংক্রান্ত তথ্য আহরণ ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
প্রায় পাঁচ থেকে দশ বছর অন্তর কৃষিশুমারি করে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা-ও সরকারি নীতিতে কাজে লাগানো হয় না। অন্যদিকে প্রকল্পভিত্তিক কিছু গবেষণায় যে তথ্য পাওয়া যায়, তা-ও খুব একটা কাজে লাগানো হয় না। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা আমরা মাঝেমধ্যে শুনি। প্রকল্পভিত্তিক গবেষণায় চাষযোগ্য জমির যে পরিমাণ পাওয়া যায়, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের তুলনায় মাঝারি ও বড় শ্রেণিভুক্ত কৃষকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্পে বিষয়টি দৃশ্যমান। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে জরিপভুক্ত ১৬টি উপজেলায় প্রায় ৮০ শতাংশ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। অন্য একটি সমীক্ষারও প্রায় একই চিত্র। দুই সমীক্ষায় জমি লিজ নিয়ে চাষ করার বিষয়টি দৃশ্যমান। এ ধরনের লিজ প্রথায় নগদ অর্থও ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে এ কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় যে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরাই কৃষি অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এঁরাই নগদ অর্থে কৃষি উপকরণ ক্রয় করেন। খাদ্যশস্য উত্পাদনে এঁরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা আমরা নীতিনির্ধারকদের কাছে শুনি, তাঁরা কি বলতে পারবেন এঁরা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে সক্ষম কি না। তবে যে বিষয়টি উল্লিখিত সমীক্ষায় জানা যায় তা হলো, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের গুণগত মান যথেষ্ট উন্নত। এর সূচক হলো, নিরাপদ পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃষিজীবীদের সুযোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যার হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। এ ধরনের দৃশ্যপট নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
একই সঙ্গে হতাশাব্যঞ্জক চিত্রও রয়েছে। দেশে দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বলেন যে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর অর্থ এই নয় যে খাদ্যশস্য একেবারেই আমদানি করা হয় না। প্রতিবছরই দুই-তিন মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য, চাল ও গম আমদানি হয়। চাল উত্পাদনে দেশ হয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। চালসহ অন্যান্য খাদ্য যথেষ্ট পরিমাণে আমদানি করতে হয়। অপুষ্টি আগের তুলনায় কমলেও কমার গতি শ্লথ। তবে গবেষকদের মতে, এ ধারা বিশ্বব্যাপী। খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় বৈচিত্র্য না আনতে পারলে পুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। পুষ্টি অর্জনের জন্য কৃষিজাত পণ্য উত্পাদনে বৈচিত্র্য আনা অতি প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রয়োজন কৃষকের আয় বৃদ্ধি। বহু বছর ধরে বারবার যে কথা শোনা গেছে এবং এখনো শোনা যায়, তা হলো—এ দেশে চাল উত্পাদন অধিক মাত্রায় হচ্ছে। অর্থাৎ কৃষকরা চাল উত্পাদনেই আগ্রহী। অথচ অন্যান্য ফসল যথা মসলাজাতীয় পণ্য বা ডাল উত্পাদনে অধিক মূল্য পাওয়া সম্ভব। এ ধরনের উত্পাদনপ্রক্রিয়ায় কৃষি উত্পাদনে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। কৃষকরা কেন এদিকে মনোযোগী নন। এর আংশিক উত্তর হলো, বসতবাড়িভিত্তিক খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই কৃষক চাল উত্পাদনে আগ্রহী। কৃষক কখনো উত্পাদিত চালের পুরোটাই বিক্রি করে না। নিজস্ব প্রয়োজনে কিছু চাল বাড়ির জন্য সংরক্ষণ করে। তবে এ কথাও সত্যি যে কোনো কোনো অঞ্চলে চাল ছাড়াও কৃষকরা অন্যান্য ফসল উত্পাদন করছেন। যেমন—ভুট্টা, আলু এবং সীমিত ক্ষেত্রে ডাল। সবজি উত্পাদনের পরিমাণও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর উচ্চ আয়ের দেশ। এ ধরনের উত্তরণ প্রক্রিয়ায় কৃষকদের মাথাপিছু নিট আয় কত হবে, তা বিবেচ্য।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা