মোফাজ্জল করিম । খােলা বাজার২৪।। বৃহস্পতিবার , ১৮ মে, ২০১৭: মেলবোর্নের মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্তরের দশকে স্নাতকোত্তর ক্লাসে পিটার বাউডেন ছিলেন আমার শিক্ষক। বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রশাসন ব্যবস্থার ওপর একটা গবেষণামূলক কাজ করার সময় পিটার ছিলেন আমার ‘গাইড’। চল্লিশোর্ধ আমুদে, নিরহঙ্কার এই মানুষটি যতটা না ছিলেন আমার গুরু, তারচেয়ে বেশি ছিলেন বন্ধু। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা এসেছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কী একটা কাজে। সেটাই ছিল তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। সপ্তাহখানেক থেকে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর হোটেলের লবিতে বসে কফি খেতে খেতে গল্প করছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পিটার কেমন লাগল বাংলাদেশ?’ ‘ভালো’। কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে পিটার বললেন, ‘তবে তোমরা এত ঝগড়া করো কেন বলতো? কথা বলতে শুরু করলেই লেগে যায় ঝগড়া। ’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘আমাদের অনেক বদনাম আছে ঠিকই, কিন্তু আমরা ঝগড়াটে জাতি এটা তো শুনিনি কোনোদিন। তোমার এমন ধারণা কেন হলো একটু খুলে বলবে?’ জবাবে পিটার যা বললেন তার মর্মার্থ হচ্ছে এই : তিনি বাংলা বোঝেন না, তবে যখন দুই বাঙালি নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তখন তাদের কথা শোনার চেষ্টা করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, বাঙালিরা স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার সময়ও শুরু থেকেই এমন চড়া গলায় কথা বলে যেন ঝগড়া করছে। বিদেশে এত জোরে কথা বলা মানে হচ্ছে, বক্তা-শ্রোতা দুজনেই উত্তেজিত হয়ে বাক্যবিনিময় করছে, পরবর্তী পর্যায়ে যা অতি দ্রুত হাতাহাতিতে পরিণত হতে পারে। ‘এত জোরে কথা বললে তো তোমাদের কানের পর্দা বেশি দিন লাস্টিং করার কথা না। তোমাদের দেশে কি কানে খাটো লোকের সংখ্যা বেশি?’ জানতে চাইলেন পিটার। …
এরপর প্রায় সাড়ে তিন দশক পার হয়ে গেছে। সেই সময়ের ৯ কোটি মানুষের দেশের লোকসংখ্যা মাশাল্লাহ শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এখন ১৬ কোটি! মতান্তরে ১৭ কোটি। এত লোকের কণ্ঠধ্বনিতে প্রতি মুহূর্তে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে, গাছপালা আন্দোলিত হচ্ছে, পশু-পাখি ভয়ে ছুটাছুটি করছে। আমরা এগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি না, এই যা।
এই সেদিন টিভিতে শব্দদূষণের ওপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠান দেখছিলাম। বিশ্ব শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ না কী দিবস জানি পালিত হচ্ছিল সেদিন। বিশেষজ্ঞরা অনেক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পরিবেশের ওপর মাত্রাতিরিক্ত শব্দের ভয়াবহ প্রভাবের কথা বলছিলেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কথোপকথন থেকে শুরু করে আলাপ-আলোচনা, সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল সবখানে আমরা মনে করি উচ্চস্বরে কথা না বললে বুঝি শ্রোতা আমার কথা শুনবে না, বা শুনতে চাইবে না। ভাবটা এমন, আমি কষ্ট করে এত ‘মূল্যবান’ একটা কথা বলছি, আর তুমি সেটা শুনবে না, এ হতে পারে না। তোমাকে শুনতেই হবে, শুনিয়ে ছাড়ব বাছাধন। এর জন্য উচ্চগ্রামের প্রক্ষেপণযন্ত্র অর্থাৎ মাইক্রোফোন ও আওয়াজবর্ধক যন্ত্র (লাউড স্পিকার) এমন যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করব যে তুমি রাত দুপুরে ঘুমিয়ে থাকলেও যেন সুখনিদ্রা ত্যাগ করে উঠে বসে শোনো কী জরুরি শব্দমালা আমি ছড়িয়ে দিচ্ছি ইথারে। পাশেই হাসপাতালে কি কোনো মৃত্যুপথযাত্রী রোগী আছে, না কোনো উপাসনালয়ে মানুষজন প্রার্থনায় নিমগ্ন, নাকি পরদিন সকালে কোনো শিক্ষার্থীর জটিল কোনো পরীক্ষার জীবন-মরণ সমস্যা—এসব দেখার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমার একমাত্র লক্ষ্য, জোর-জবরদস্তি করে হলেও আমার ‘মূল্যবান শব্দগুচ্ছ’ সর্বসাধারণের ‘কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট করাইয়া মর্মমূলে পৌঁছাইয়া দেওয়া’। আমার সংবিধান, আমার স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক, আমার দেশের প্রচলিত আইন আমাকে অধিকার দিয়েছে কথা বলার, কথা শোনানোর, তুমি সেখানে বাধা দেওয়ার কে হে?
আমি? আমি একজন নাগরিক। তোমাকে যেটুকু অধিকার রাষ্ট্র দিয়েছে, আমাকেও সেটুকু দিয়েছে। রাস্তার আন্ধা, লুলা ভিক্ষুককেও সেটুকু দিয়েছে। অতএব নিশ্চয়ই আমি বাধা দেব। বাধা দেবার অধিকার আমার আছে। কেন, স্কুল-কলেজে পৌরনীতির বইয়ে ‘রাইট ইমপ্লাইজ ডিউটি’—অধিকারের উল্টো পিঠে আছে কর্তব্য—এই কথাটি পড়নি? ওটাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে কেতাবে লেখা আছে। অর্থাৎ রাস্তায় গাড়ি চালানো তোমার অধিকার, মাইকে বক্তৃতা দেওয়া, ঘরে ব্যান্ড মিউজিক শোনা, আমার কুঁড়েঘরের পাশে তোমার জমিতে বিশতলা দালান নির্মাণ, নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর স্রোতকে ভিন্নমুখে প্রবাহিত করা, রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকন্দ্র স্থাপন করা—এসবই তোমার রাষ্ট্রস্বীকৃত, সংবিধান প্রদত্ত, আইনসম্মত অধিকার। এ রকম আরও হাজার হাজার অধিকার তোমার আছে মানলাম। কিন্তু সেই অধিকারের পাশাপাশি লেখা আছে তোমার ডিউটি বা কর্তব্যের কথা, দায়িত্বের কথা। গাড়ি চালাতে পারো, যত খুশি চালাতে পারো, কিন্তু মানুষ মেরে নয়, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে নয়। বক্তৃতা দাও, গান শোনো, কিন্তু অপরের শান্তি বিনষ্ট করে, শ্রবণেন্দ্রিয়ের বারোটা বাজিয়ে নয়। নদীতে যেখানে খুশি বাঁধ দাও, কিন্তু নিম্ন অববাহিকার মানুষকে পানিবঞ্চিত করে নয়, বিদ্যুৎকন্দ্র স্থাপন কর কিন্তু সুন্দরবনকে স্লো পয়জনিং করে মেরে ফেলে নয়। … তুমি কথা বল, নিশ্চয়ই বলবে, নইলে জগৎ সংসার চলবে কী করে। কিন্তু তোমার স্বরযন্ত্র এবং শ্রোতার শ্রবণযন্ত্রকে বিপন্ন করে কথা বলা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
গ্রামীণ মানুষ, বস্তির মানুষ আবহমানকাল ধরে জোরে চিৎকার দিয়ে কথা বলে অভ্যস্ত। এর ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে তারা অবহিত নয়। তারা জন্মের পর থেকে জোরে জোরে কথা বলতে দেখে আসছে মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে। এক হাত দূরের মানুষটিও কথা বলে চেঁচিয়ে। (আমার শিক্ষকবন্ধু পিটারের কাছে যা মনে হয়েছিল ঝগড়ার মত)। যেন এক হাত নয়, এক শ হাত দূরের লোকের সঙ্গে কথা বলছে। এর বিপরীতে শহরের মানুষ পারিবারিক পরিবেশ, সংস্কৃতি-কৃষ্টি, স্কুল-কলেজে শিক্ষা-দীক্ষা-শৃঙ্খলা ইত্যাদির কারণে গলার স্বর সচরাচর স্বাভাবিক মাত্রায় রেখে কথা বলে। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক, যারা বিষয়টিকে কোনো ব্যাপারই মনে করে না। অবশ্য এখন শহরে-গ্রামে-গঞ্জে সবখানে যেহেতু শিক্ষার হার বেড়ে চলেছে, আশা করা যায়, এর প্রতিফলন দেখা যাবে গ্রামের মানুষের চলনে-বলনে-কথনেও।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে জোরে কথা বললে বা অন্যের বিরক্তি উদ্রেক করার মতো প্রকাশ্যে কোনো আচরণ করলে আমাদের বলার মতো একটা অজুহাত ছিল যে আমরা পরাধীন দেশের নাগরিক। সভ্য দেশের চালচলন, রীতিনীতি, আদব-কায়দা (‘এটিকেট’) কতটুকুই বা দেখেছি, শিখেছি! কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও কি আমরা এখনও নাবালকই থেকে যাব? এটা কি পাকিস্তানি আমলের সেই ‘শিশু রাষ্ট্রের’ মতো? পাকিস্তানের জন্মের (১৯৪৭) পর বহুকাল অবধি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের মুখপাত্রেরা যে-কোনো বিষয়ে তাদের ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অযোগ্যতা ঢাকতে দোহাই দিত ‘শিশু রাষ্ট্রের’। এভাবেই সিকি শতাব্দী কেটে যাবার পর যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল, তখনও বোধ হয় তারা নার্সারি ক্লাসে পড়ুয়া অবোধ শিশুটির মতো শিশু রাষ্ট্রই থেকে গিয়েছিল। তা না হলে রাষ্ট্র পরিচালনায় আগাগোড়া অমন চরম ব্যর্থতা, স্বার্থপরতা ও গোয়ার্তুমির পরিচয় দেবে কেন? যাকগে। বাদ দিন ওদের নির্বুদ্ধিতার কথা। তারা যা করেছিল তার পরিণাম তারা ভোগ করেছে হাতেনাতে এবং এখনও করছে। এর থেকে তাদের উত্তরণ না হলে অচিরেই তাদের ‘খেল খতম, পয়সা হজম’ হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু আমরা তো পৃথিবীতে একটি সংস্কৃতিবান, সুসভ্য, সৌন্দর্যের কদরদান জাতি হিসেবে পরিচিত। আমাদের রুচিশীলতার প্রশংসা তো বিশ্ববাসীর মুখে মুখে। আমরা তা হলে কেন স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের কিছু কিছু অত্যন্ত অশোভন, গর্হিত আচরণ বর্জন করতে পারব না? সভ্য সমাজে নিন্দনীয় ও লজ্জাকর এসব অভ্যাস পরিত্যাগ করা কি এতই দুরূহ? বিশেষ করে যুদ্ধ করে নয় মাসে দেশ স্বাধীন করা একটা জাতির পক্ষে?
২.
বহুকাল আগে কার জানি লেখা একটি নিবন্ধ পাঠ করেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল বোধ হয় ‘বাঙালির অবসর বিনোদন’ বা ওইরূপ কিছু। ওই নিবন্ধে লেখক ব্যঙ্গাকারে বাঙালির কিছু কিছু বদভ্যাসের কথা তুলে ধরেছিলেন। যেমন বাঙালি কখনও কখনও জনসমক্ষে নিবিষ্ট মনে তর্জনি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নাসিকা থেকে নাসামল আহরণ করে তা দিয়ে গুটলি পাকায়। (ইংরেজিতে এই কাজটিকে বোধ হয় বলে ‘ডিগিং গোল্ড ফ্রম দ্য নউজ’। যে অখণ্ড মনোযোগ সহকারে ওই মহামূল্যবান বস্তুটির জন্য খননকার্য চালানো হয়, তা বোঝাতে এই নামকরণটি মনে হয় যথার্থই বটে। ) তেমনি দুই বাঙালি একত্র হলেই অবশ্যম্ভাবীরূপে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কুৎসা গাইতে শুরু করবে, মেতে উঠবে পরচর্চা-পরনিন্দায়। লেখক এমনি আরও কিছু কিছু বিষয়ের ওপর—যা একান্তই বাঙালির ‘ট্রেডমার্ক’—ওই নিবন্ধে আলোকপাত করেছিলেন।
এই কলামের স্বল্পপরিসরে এমনি আরও দু’একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। জোরে চিৎকার দিয়ে কথা বলার মতো আরেকটি অত্যন্ত অশোভন ও অভদ্র আচরণ হচ্ছে কথার মাঝখানে কথা বলা। কেউ কোনো বিষয়ে কথা বলছে, তার কথা শেষ না হতেই আরেকজন—যার জিহ্বা যেন অনেকক্ষণ ধরে চুলবুল করছিল—কথা বলতে শুরু করে দিলেন। যেন বক্তাকে থামিয়ে, তার কথার মাঝখানে কথা না বললে সুযোগ হারিয়ে যাবে। এমনও দেখা যায়, চার ব্যক্তি বসে কথা বলছেন, কিন্তু একজন বলছেন, বাকি তিনজন শুনছেন তা নয়, বক্তা ও শ্রোতারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেটা আবার প্রায়শই হয় কোণাকুণিভাবে। অর্থাৎ ক খ গ ঘ আয়তক্ষেত্রের ক তার কোণাকুণি বসা গ-এর সঙ্গে এবং খ ঘ-এর সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠেছেন। এ ধরনের তথাকথিত আলোচনার ফলাফল যে কী হয় তা সহজেই অনুমেয়।
আরেকটা অত্যন্ত জঘন্য কাজ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভদ্র-অভদ্র অনেকেই আমাদের দেশে পথেঘাটে হরহামেশা করে চলেছে। তা হচ্ছে, যেখানে-সেখানে, যখন-তখন কফ-থুতু ফেলা এবং নাক ঝাড়া। যারা এটা করে, তারা এটাকে মোটেই দোষণীয় কিছু বলে মনে করে না। আপনি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই এক লোক ‘ওয়াক থু’ বলে একদলা কফ বা থুতু আপনার কাছেই ফেলে দিল। অথবা আপনার প্রায় গা ঘেঁষেই (গড ফরবিড) দিল নাক ঝেড়ে। তখন কেমন লাগে বলুন তো? আর বলবেনই বা কী। এ-বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী। অথচ এসবের কোনো প্রতিকার নেই। এরা কেউ ময়লা-আবর্জনা বা থুতু ফেলার কাজটি পাশেই মাননীয় নগরপিতার নামাঙ্কিত পাত্রে করতেও নারাজ। হয়ত তাদের ধারণা, এতে নগরপিতাকে অসম্মান করা হবে। হবেও বা। (প্রসঙ্গত, ওইসব বর্জ্য ফেলার পাত্রে মাননীয় নগরপিতার নামটি লেখা না থাকলেই কি নয়? এটা আমাদের জনৈক ভূতপূর্ব মন্ত্রীপ্রবরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি নাকি তাঁর এলাকায় ছোট-বড়-মাঝারি, খ্যাত-অখ্যাত-অবজ্ঞাত যে কোনো স্থাপনায় তাঁর নামখচিত শিলালিপি বসাতে অতি উৎসাহী ছিলেন। সেটা লক্ষ্য করে তাঁর বিরোধীদলীয় এক দুর্মুখ নাকি একবার বলেছিল, তা হলে এলাকার টয়লেটগুলো আর বাদ রইল কেন?)
টয়লেট বলতেই মনে পড়ল, অনেকে দেখা যায় ‘চাপে পড়ে’ রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ‘জলবিয়োগ’ করতে বসে যান/দাঁড়িয়ে যান। এটার জন্য নিরোধক আইন আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে এই আইনটা ‘পাঁচ আইন’ নামে পরিচিত। তবে এর প্রয়োগ কখনও দেখা যায় না। এর আওতায় কোনোদিন কারো শাস্তি হয়েছে বলেও শুনিনি। অন্তত ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে তো নয়ই। ঢাকা ও অন্যান্য দু’চারটা বড় শহরে পাবলিক টয়লেট আছে ঠিকই, তবে এগুলো সংখ্যায় খুবই অপ্রতুল ও চেহারা-সুরতে জঘন্য। ইদানীং ঢাকায় লক্ষ্য করেছি, এগুলোকে কিছুটা হলেও মানসম্মত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাধু। আর কতকাল আমরা এসব প্রাকৃতিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে আদিম যুগে বসবাস করব।
আরও কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর ব্যাপারে আইন না মানাটাই যেন আইন। যানবাহন চালক ও পথচারীদের ট্রাফিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে চলাচল এমনি একটা বিষয়। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য, শৈথিল্য ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কেন ট্রাফিক আইন মানা হয় না জিজ্ঞেস করলেই পথচারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই এক শ একটা অজুহাত খাড়া করবেন। অথচ ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে, অকারণে হর্ন না বাজাতে বা জেব্রা ক্রসিং এবং ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হতে কোনো পয়সা খরচ হয় না। আসল ব্যাপার তা না। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আইন না মেনে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। আর এতে মদদ দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে আইন প্রয়োগকারীরা। ফলে দু’য়ে দু’য়ে সহজেই চার হচ্ছে আইন অমান্য করার বেলায়।
৩.
এতক্ষণ নিজেদের চেহারা ভাঙা আয়নায় দেখে দেখে আপনারা নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন। আসুন দুটো চুটকির চাটনি দিয়ে বিরক্তি দূর করি।
দুই ‘ঠসা’ (বগুড়ার কথা। অর্থ, বধির। ) সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। একজন মুখ হাসি হাসি করে বলল, কী, বাজারে যাচ্ছেন নাকি? অন্যজন জবাব দিল, না, একটু বাজারে যাচ্ছি। প্রথমজন বলল, ও, আমি ভাবলাম বাজারে যাচ্ছেন। … (শব্দাক্রান্ত হতে হতে এই অবস্থা আপনার আমার যে কারো হতে পারে। অতএব, সময় থাকতে এক্ষুনি সাধু সাবধান। )
অপর চুটকিটি যেখানে-সেখানে থুতু ফেলাবিষয়ক। চুটকিটি পাকিস্তানি আমলের। করাচির রাস্তায় বাস যাচ্ছে। বাসের ছাদের নিচে বড় করে লেখা : ইঁহা থুক্না মানা হ্যায় (এখানে থুতু ফেলা নিষেধ)। তবুও এক পাঠান যাত্রী একটু পরে পরেই বাসের ভেতর থুতু ফেলছিল। তাই দেখে অন্য এক যাত্রী লেখাটি দেখিয়ে পাঠানকে বলল, ওয়ে, দেখতা নেহি ওঁহা লেখ্যা হ্যায় ‘ইঁহা থুক্না মানা হ্যায়’। ফের ভি কিঁউ থুকতে হো? পাঠান আঙ্গুল উঁচু করে লেখাটি দেখিয়ে নির্বিকারভাবে জবাব দিল, হাঁ ভাই, লেখ্যা হ্যায়, ওঁহা থুকনা মানা হ্যায়, ইঁহা নেহি। আভি বাতাও মেরা কিয়া কসুর?
৪.
বাঙালি এখনও এত ঠসা বা বধির হয়নি যে তার কানে কথা ঢুকবে না। সময়মত সঠিকভাবে ঢোকালেই ঢুকবে। আর তা হতে হবে পরিবারে, স্কুলে, আলাপ-আলোচনায়, সবখানে। এর জন্য বিশাল অঙ্কের বাজেটের দরকার নেই, আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার কর্মশালাও লাগবে না। কেবল যার যার বাড়িতে-পাড়ায়-মহল্লায়-ওয়ার্ডে-মসজিদে আলোচনা করুন, তা হলেই হবে। আর মনে রাখবেন, বাঙালি যথেষ্ট বুদ্ধিমান জাতি, সে মর্কট পাঠান নয় যে বুঝবে না কোথায় থুতু ফেলতে মানা করা হয়েছে।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি, [email protected]
[সংকলিত]