Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

19kআবু আহমেদ : খােলা বাজার২৪।। রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭: সুদের হারের সঙ্গে সঞ্চয়ের সম্পর্ক আছে, আবার নেইও। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ নিয়ে অর্থনীতি শাস্ত্রে অনেক কথা লেখা আছে। সঞ্চয়কে বলা হয়েছে বর্তমান আয় থেকে যে অংশ ভবিষ্যৎ ভোগের জন্য রেখে দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিনিয়োগের সংজ্ঞা হলো নতুন করে ক্যাপিটাল স্টকে বা মূলধনী সম্পদে কিছু যোগ করা। তবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সব সময় একই ব্যক্তিরা করে না। সঞ্চয় করে এক দল, অন্য দল বিনিয়োগ করে। যারা সঞ্চয় করে তারা সরাসরি বিনিয়োগের দলের হাতে অর্থ তুলে দেয় না, তারা সাধারণ ব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা করে আর ব্যাংক বা এজাতীয় প্রতিষ্ঠান সেই সঞ্চয়কে বিনিয়োগের জন্য অন্য ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়। এ ক্ষেত্রে অন্য পক্ষ থেকে ব্যাংক অর্থ দিলে বলা হয় ব্যাংক ডিপোজিট বা আমানত নিয়েছে আর ব্যাংক যখন অন্য পক্ষকে সেই আমানত বিনিয়োগ ভোগ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে প্রদান করে, সেটাকে বলা হয় ল্যান্ডিং বা ব্যাংক ঋণ।

ব্যাংক চলে অন্যের অর্থে, ব্যাংকের মূল ব্যবসা হলো জমাকৃত অর্থকে ব্যবসায়িক কাজে, বিনিয়োগে-ভোগের জন্য ঋণ দেওয়া। দুদিকেই মূল্য হিসাবে বিবেচিত হয় সুদ নামের একটা মূল্য। ডিপোজিট বা আমানত নিতে ব্যাংককে সুদ দিতে হয়। আবার সুদের বিপরীতে ঋণ দিয়ে ব্যাংক ব্যবসা করে। ব্যাংক ব্যবসা করতে গিয়ে বিপদেও পড়ে। খারাপ ঋণ ব্যাংকের ব্যালান্সশিট বা স্থিতিপত্রে জমা হলে ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়তে পারে। তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় মালিকদের থেকে পুনরর্থায়ন নিয়ে অথবা স্বল্প মেয়াদের জন্য বন্ড বিক্রি করে। তবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক আজকাল ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি নিয়ে খুবই সজাগ। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক ব্যাংকগুলো, সরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া প্রায় সবগুলোরই মূলধন উদ্বৃত্ত আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলধন ঘাটতির বিষয়টি অতি গুরুত্ব দিয়ে দেখে এ জন্যই যে যাতে করে ডিপোজিটরদের স্বার্থ হানি না হয়। ডিপোজিটররা নিরাপদে থাকুক, এটাই হলো ব্যাংক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। যাহোক, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এসব ভেরিয়েবলস (variables) বা চলক একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। অর্থনীতিশাস্ত্র একেবারে প্রথমেই একটা সমীকরণ শেখায়, তা হলো আয় সমান ভোগ এবং সঞ্চয়। অর্থাৎ আয় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে, এক অংশ যাবে ভোগে, অন্য অংশ যাবে সঞ্চয়ে। ভোগ বেশি হলে সঞ্চয় কম হবে। এবং ভোগ কম হলে সঞ্চয় বেশি হবে। ভোগে পূর্ণ আয়টাই ব্যয় হয়ে যেতে পারে, তখন সঞ্চয় হবে শূন্য। আর ধার করে ভোগ করলে সঞ্চয় হবে ঋণাত্মক। অনেকে ধার করে ভোগ করে, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাকে ধার দেয় এই আশায় যে ভবিষ্যতে সেই ধারটা ফেরত দেবে। ব্যাংকের কাজই হলো ঋণ বিক্রয় করা। সুতরাং চলমান অর্থনীতিতে ঋণের অভাব হয় না। ঋণ নেওয়া, ঋণ ব্যয় করার মধ্যেও বড় রকমের অর্থনীতি আছে। বলা হয়, যে অর্থনীতিতে ঋণের চাহিদা নেই, সেই অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েছে। একসময় সেই অর্থনীতি পেছনের দিকেও যেতে পারে। সে জন্যই ঋণ-বিনিয়োগ এসবের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কি না সেটা সরকার বা অন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দেখে। যদি ঋণের প্রবাহ কমে, তাহলে কেন কমল সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়। অর্থনীতিতে যত বেশি অর্থ ব্যবহৃত হবে ততই ভালো। যত বেশি বলতে পরিমাণগত এবং ব্যবহারের ঘনত্ব বোঝায়। একই অর্থ অর্থনীতিতে অনেকবার ব্যবহৃত হতে পারে। আবার অর্থনীতিতে অলস ভাব দেখা দিলে সেই একই অর্থের কম ঋণ ব্যবহার হবে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতিতে বেশি মুদ্রা ছাড়লেও কাঙ্ক্ষিত কাজ দেবে না।

যাহোক, সুদের হারের সঙ্গে যে সঞ্চয়ের একটা সম্পর্ক আছে সেটা বেশির ভাগ শিক্ষিত লোক মনে করেন। তাঁদের ভাবনা হলো, সুদ কমে গেলে লোকে তো ব্যাংকের সঞ্চয়ী আমানতে অর্থ রাখবে না, তারা তো আয়কে ভোগে ব্যয় করবে। এ অবস্থায় বিনিয়োগের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তাতেও টান পড়বে। তবে তাদের এই ভাবনা সর্বাংশে সত্য নয়। যেসব দেশে ব্যাংকের সুদের হার শূন্য, সেসব দেশে কি বিনিয়োগ হচ্ছে না? আসলে ব্যাংকের সুদের হার কমে গেলে যেটার পরিবর্তন ঘটে সেটা হলো সুদের জন্য আমানতের বা ডিপোজিটের পরিমাণ কমে যায়, কিন্তু অন্য আমানত ঠিকই বেড়ে যায়। একবার ভাবুন তো, আপনি যদি শুধু ব্যাংক প্রদত্ত সুদের হারের কমতির কারণে ব্যাংকের সঞ্চয়ী বা টার্ম হিসেবে অর্থ রাখলেন না, যেহেতু সুদ আয় প্রায় শূন্য। সে জন্য আয়কে ভোগে ব্যয় করে ফেললেন, কিন্তু আপনার ভোগজনিত ব্যয় তো অন্যের জন্য রেভিনিউ বা রাজস্ব আয়। সেই আয় তো ব্যাংকের হিসাবে ঠিকই জমা পড়বে। তবে সঞ্চয়ী হিসাবে নয়, চলতি হিসাবে। এ জন্যই অর্থনীতিতে যখন ব্যাংক প্রদত্ত সুদের হার কমে যায় তখন অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বেড়ে যায় এবং ব্যাংক সঞ্চয়ী হিসাবে কম অর্থ গ্রহণ করে কিন্তু চলতি হিসাবে বেশি অর্থ নিয়ে থাকে। আর বিনিয়োগের ওপরও কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। কারণ হলো ব্যাংক চলতি হিসাবের আমানত থেকে স্বল্প মেয়াদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বা ব্যক্তির ভোগের জন্য ঋণ দেয় আরো বেশি করে। কম সুদে ঋণ পাওয়া যায় বলে ঋণের চাহিদা বেড়ে যায়। প্রশ্ন হতে পারে, কম সুদের অবস্থায় ব্যাংক দীর্ঘ মেয়াদের অর্থায়নে যায় কি না। যায়, তবে আগের তুলনায় হ্রাসকৃত হারে।

দীর্ঘ মেয়াদের অর্থায়নের জন্য কম্পানি বা ব্যবসায়িক সত্তা পুঁজিবাজার ও বন্ড (Bond) মার্কেটের দিকে ঝোঁকে। ব্যক্তির দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগের জন্য বা তাদের স্থায়ী মূলধন সংগ্রহের উপযুক্ত জায়গা হলো ক্যাপিটাল মার্কেট বা পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজারে যারা পুঁজির জোগান দেয় তারা সত্যিকার অর্থে কম্পানির ব্যবসার অংশ কিনে। কোনো কম্পানিকে বিশ্বাস করলে বিনিয়োগকারীরা উচ্চ মূল্য দিয়ে হলেও ওই কম্পানির শেয়ার বা ইকুইটি ক্যাপিটালের অংশ কেনে। তবে বাংলাদেশে লোক ঠকানোর সংস্কৃতিটা এ ক্ষেত্রেও প্রবল। আসলে ঠকাবার লোকেরা ব্যাংকের কাছে যেমন ঋণখেলাপি হয় পুঁজিবাজারেও ঠকানোর কৌশলের পেছনে ছোটে। তবে এসব ব্যবসায়ী বড় হতে পারে না, ব্যক্তিগতভাবে এরা কথিত বড়লোক হলেও সামাজিকভাবে এরা নাম কুড়াতে পারে না। প্রথমে না চিনতে পারলেও একটা সময়ে লোকে বুঝে ফেলে কারা ঠকানোর উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নিয়েছে। আর কারা বড় হয়েছে সত্য, তবে সবাইকে নিয়েই বড় হয়েছে। সুদের হার কমে গেলে যারা অতীতে ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে অর্থ রাখত, তাদের একটা অংশ তাদের অর্থ নিয়ে অন্য অ্যাসেট মার্কেটগুলোতে যেতে পারে, যার অন্যতম হলো স্টক মার্কেট তথা শেয়ারবাজার। অন্য দেশে স্বর্ণ এবং কামোডিটি (commodity) মার্কেটেও বিনিয়োগ করা যায় কিন্তু বাংলাদেশ তার সব অ্যাসেট মার্কেটকে আজও বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করেনি। এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সেটা আমার মতো লোক বুঝলে লাভ হবে না, বুঝতে হবে পলিসি মেকারসদের।

ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয় কমে গেলে কোনো ক্ষতি নেই যদি উদ্বৃত্ত আয়টা অন্য খাতের মাধ্যমে উৎপাদন-বিনিয়োগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। অন্য কথা হলো, বিনিয়োগ যে শুদ্ধি সঞ্চয় থেকে আসে, এই ধারণাও ভুল। সত্য হলো অনেক দেশে বিনিয়োগের বেশির ভাগটাই আসে কম্পানিগুলোর রিটেইন্ড আর্নিং বা রিজার্ভে জমাকৃত অর্থকে মূলধনীকরণের মাধ্যমে। কোনো কম্পানি যদি ব্যবসাকে বড় করতে চায়, তাহলে সে নিজের তহবিলের অবণ্টনকৃত মুনাফাকে বোনাস শেয়ার ইস্যু করে ইকুইটি ক্যাপিটাল বাড়াতে পারে। রিটেইন্ড আর্নিং, ইকুইটি ক্যাপিটালে রূপান্তর করা মানেই হলো নতুন বিনিয়োগ। যেসব কম্পানি ভবিষ্যৎ ভালো দেখে তারা ব্যবসা বড় করার কাজে হাত দেয় এবং সেই কাজে যে মূলধন বা বিনিয়োগ প্রয়োজন সে সেটার জোগান বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়