খােলা বাজার২৪।। বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০১৭: ইকরামউজ্জমান
ক্রিকেটীয় আবেগে সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের ওভাল গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড পরস্পর মুখোমুখি হওয়ার মধ্য দিয়ে আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট অষ্টম চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। বিশ্ব ক্রিকেটে অভিজাত আট দেশের মধ্যে ৫০ ওভারের খেলায় এখন কে সেরা—এটা জানা যাবে এই ওভালেই ১৮ জুন ফাইনাল ম্যাচের পর। জানা যাবে কোন দেশ পাচ্ছে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ট্রফির সঙ্গে বাংলাদেশের মুদ্রায় ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা ‘প্রাইজমানি’।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বিশ্বকাপের থেকেও কঠিন। বিশ্বকাপে গ্রুপের ম্যাচগুলোতে দলগুলো সময় পায় টুর্নামেন্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য—এখানে সেই সুযোগ নেই। বিশ্বের সেরা আট দলের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই প্রথম থেকেই সেরাটা ঢেলে দিতে না পারলে সম্ভাবনা খুব দ্রুতই কমে যাবে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের রং কিন্তু ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে! টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রভাবে ওয়ানডে ক্রিকেট হয়ে পড়েছে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। দলীয় লড়াইয়ে এসেছে পরিবর্তন। দলে বেড়েছে অলরাউন্ডারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। বেড়েছে মাঠে অভিজ্ঞতার গুরুত্ব ও ক্রিকেটারদের ফর্ম।
আইসিসির ‘এলিট’ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ওয়ানডে রাংকিংয়ে এখন ৬ নম্বরে অবস্থান করে অংশ নিচ্ছে। এর আগে ২০০০ সাল থেকে চারটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে আটটি খেলার মধ্যে ২০০৬ সালে শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতেছে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ আর অংশ নিতে পারেনি আইসিসি ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের শীর্ষ আট দলের মধ্যে টুর্নামেন্টকে সীমাবদ্ধ করে ফেলায়। এবার (২০১৭) বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে আবশ্যিক যোগ্যতার থেকে আরো বেশি নিশ্চিত করে। এটা ক্রিকেটারদের সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ।
এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শুরু ১৯৯৮ সালে ঢাকা থেকে। তখন নাম ছিল উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ। প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। এটাই প্রথম ও এখন পর্যন্ত আইসিসির বৈশ্বিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে তাদের শিরোপা জয়। বাংলাদেশ তখন ‘টেস্ট স্ট্যাটাস’ পায়নি। আইসিসির সহযোগী দেশ বাংলাদেশ বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট সফলতার সঙ্গে আয়োজন করে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল, যা পরে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার রায়ের পাল্লাকে ভারী করেছে!
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ক্রিকেট অনুরাগীরা এবারই প্রথম মিস করবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তাঁদের রোমাঞ্চকর আনন্দঘন ক্রিকেট। ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটের মধ্যে থাকতে না পারায় একবার চ্যাম্পিয়ন ও দুবার রানার্স-আপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতই শুধু তিনবার ফাইনাল খেলেছে এর আগে।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অংশগ্রহণকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। টিম বাংলাদেশ এবার অংশ নিচ্ছে নির্দিষ্ট চিন্তা, সংকল্প, পরিকল্পনা ও লক্ষ্য সামনে রেখে। পাঁচ বছর আগে দেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ঘিরে যে ভাবনা ও স্বপ্নের কথা ভাবা হয়নি, সেটাই বাস্তবে বাস্তবায়িত করেছেন ক্রিকেটাররা আত্মবিশ্বাস, সাহস, নিজের ওপর আস্থা, ইতিবাচক মানসিকতা ও মাঠে সামর্থ্যের প্রয়োগে সুবিচার করে। সর্বোপরি ক্রিকেটাররা দেশের হয়ে সব সময় ম্যাচ জিততে চেয়েছেন—এই ভাবনা তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশ খেলেছে সম্মিলিতভাবে একটি দল হয়ে সব সময়!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলা, দেশে ও দেশের বাইরে ভিন্ন কন্ডিশনে দাপটের সঙ্গে ওয়ানডে ক্রিকেটে সাফল্য নিশ্চিত করে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সমীহ আদায়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন কন্ডিশনে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভালো খেলে চ্যালেঞ্জ জয়ের এটি আরেকটি সুযোগ। আর এই অভিজ্ঞতা আগামী বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে অনুপ্রাণিত ও সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে। আর এই উন্নতি চ্যালেঞ্জ নিয়ে, চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে শক্ত কন্ডিশনে বাংলাদেশ অসাধারণ খেলে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। সেমিফাইনালে খেলাটাও বিচিত্র ছিল না, অভিজ্ঞতার অভাব আর প্রয়োজনীয় মাঠের কাজগুলো যথাসময়ে করতে পারেনি। আগে কিন্তু ভাবা হয়নি বাংলাদেশ এত ভালো খেলবে। ক্রিকেটাররা বিষয়টি ঘটিয়েছেন মাঠে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে (২০১৫) বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেক। দেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চিন্তাভাবনা, মনমানসিকতা ও মাঠের পারফরম্যান্সে উৎকর্ষের ক্ষেত্রে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করেছে।
দেশের মাটিতে শক্তিশালী দেশগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ একটির পর একটি সিরিজ জিতেছে। বিদেশের মাটিতে সিরিজ ড্র করেছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশে সিরিজ হারলেও একটি ম্যাচে জিতেছে। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডকে পরাজিত করেছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন বিদেশের ভিন্ন কন্ডিশনে ভালো খেলা ও জেতা। কিভাবে ম্যাচ জিততে হয় এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ভালোভাবেই শিখেছেন।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বাংলাদেশের জন্য শক্ত চ্যালেঞ্জ সন্দেহ নেই। তবে বাংলাদেশকে কিন্তু হিসাবের বাইরে রাখা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে দলে অভিজ্ঞ ও তরুণ খেলোয়াড়দের ধারাবাহিকতার সঙ্গে পারফরম্যান্স, সাহস ও আত্মবিশ্বাসকে সাবেক ক্রিকেটার, ক্রিকেট পণ্ডিত ও বিশ্লেষকরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া, যারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। নিউজিল্যান্ড গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে রানার্স-আপ, এর আগে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স-আপও হয়েছে। আছে স্বাগতিক ইংল্যান্ড। যারা নিজের কন্ডিশনে খেলবে। দলটি দুর্দান্ত ফর্মে আছে। ইংল্যান্ড চাচ্ছে এবার প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ঘরে তুলতে। গতবার (২০১৩) ভারতের কাছে হেরে তারা রানাসর্-আপ হয়েছে। ইংল্যান্ড তো স্বাগতিক, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ইংলিশ কন্ডিশনে খেলে অভ্যস্ত। বাংলাদেশকে শুধু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। গ্রুপের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যাল্ডকে বাংলাদেশ কিন্তু ভিন্ন কন্ডিশনে আগেও পরাজিত করেছে। মাঠে খেলা শুরুর আগে এটাও একটি প্রেরণা। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এই গ্রুপে শুধু বাংলাদেশ নয়, ইংল্যান্ড (২০০২ ও ২০০৬) অস্ট্রেলিয়া (২০১৩), নিউজিল্যান্ড (২০০২, ২০০৪ ও ২০১৩) গ্রুপ পর্বে বিদায় নিয়েছে। ক্রিকেটের রহস্য বোঝা মুশকিল!
বাংলাদেশ যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছে। দুটিতেই পরাজিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। তবে শেষ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে পরাজয়টা শক্ত হয়েছে। যদিও প্র্যাকটিস ম্যাচ সব কিছু নয়। টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা ও টিম কম্বিনেশন সেট করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে।
টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী আট দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ছয়টি দেশই গত সাতটি আসরে ফাইনাল খেলেছে, ট্রফি জিতেছে নতুবা রানার্স-আপ হয়েছে। ফাইনালে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা ভাবা হচ্ছে না। পাকিস্তান বর্তমান দল নিয়ে কতটুকু এগোতে পারবে এটা দেখার বিষয়। ‘বি’ গ্রুপে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ইংলিশ কন্ডিশনে এশিয়ান দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত। পণ্ডিতদের রায় এবার ভারতের দিকে পাল্লাই বেশি ভারী, এরপর ইংল্যান্ডের দিকে। বিরাট কোহলির দলটা এখন প্রখর মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো জ্বলছে। ভারতের শুরু পাকিস্তানের বিপক্ষে ভালো হলেই ভারতকে রোখা মুশকিল হতে পারে। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড এবার মরিয়া। দেশের মাটিতে সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই ইংল্যান্ডকে ঘিরে আছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া তো তার আধিপত্য ধরে রাখার জন্য আবেগহীন জেতার ক্রিকেট খেলার জন্য মাঠে নামবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক