Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। বুধবার ,১৪  জুন, ২০১৭:  24গত ২ জুন শুক্রবার রাজধানীর উপকণ্ঠে পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্প এলাকার একটি পুকুরের পানির নিচ থেকে পুলিশ বিশাল অস্ত্রের ভাণ্ডার উদ্ধার করেছে। শরিফ মিয়া নামের একজন মাদক চোরাচালানির বাসা থেকে প্রথমে একটি অস্ত্র উদ্ধার এবং তাঁর দেওয়া তথ্য অনুসারে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে ওই অস্ত্রভাণ্ডারের সন্ধান পায়।

দুটি রকেট লঞ্চারসহ অত্যাধুনিক ৫৮টি চায়নিজ সাবমেশিনগান, ট্যাংকবিধ্বংসী উপাদান এবং বিপুল পরিমাণের বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বুলেট সুনিপুণভাবে বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়। খোদ রাজধানীর কিনারায় এত পরিমাণ আধুনিক কার্যক্ষম অস্ত্রের মজুদ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতন মানুষের মধ্যে সংগত কারণেই উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমেই যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হলো, রাজধানীর নিকটবর্তী স্থানে এত অস্ত্রের মজুদ কারা করছে, কেন করছে, তাদের উদ্দেশ্য কী এবং এ রকম আরো কত জায়গায় কত পরিমাণ অস্ত্র মজুদ আছে তা-ই বা কে জানে?

গতানুগতিক একটি ধারণা হলো, হয়তো কোনো চোরাচালানি গোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তারাই আপাতত এটা এখানে লুকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এর আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্রপাচার হয়েছে, সেই সূত্রে ওই গতানুগতিক ধারণার মধ্যে কিছুটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া গেলেও একাধিকবার রাজধানীর সন্নিকটে পাওয়া অস্ত্রের বেলায় সেটি শক্তিশালী যুক্তি নয়। তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল এ অস্ত্রের চালান বাইরে থেকে এসে যেকোনো সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে এবং উদ্দেশ্য ছিল অন্য আরেকটি সীমান্ত দিয়ে তা বাইরের দেশে চলে যাবে। তাই যদি হবে, তাহলে পরিপক্ব চোরাচালানি গোষ্ঠী নিশ্চয়ই তা রাজধানীর দিকে আনবে না, বরং তা নিয়ে লুকানোর চেষ্টা করবে গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি সীমান্তবর্তী কোনো নির্জন এলাকায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান দল আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, সেটিকে ঘিরে পরবর্তী সময়ের লঙ্কাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ হিসেবে ফিরিয়ে আনা এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক একাত্তরের পর্যায়ে উন্নীতকরণের মধ্য দিয়ে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সুতরাং রাজধানীর সন্নিকটে বড় পরিমাণ অস্ত্র জমা রাখার কারণে প্রথমেই ভয়ংকর যে সন্দেহটি জাগতে পারে তা হলো, এটি কি তবে তাদেরই কাজ, যারা বিগত দিনে প্রকাশ্যে গৃহযুদ্ধ বাধানোর হুমকি দিয়েছে, যারা মাসের পর মাস জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ বাধানোর পটভূমি তৈরি করার চেষ্টা করেছে, প্রকাশ্যে অবৈধ পন্থায় সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের হুমকি দিয়েছে এবং যারা নিজেরা মনে মনে ধারণ করে ও পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তাদের, যারা বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট? দেশীয় এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবশিষ্টাংশ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না। তাই সম্মিলিতভাবে দেশি-বিদেশি এই চক্রান্তকারী গোষ্ঠীগুলো কোনো সুযোগের অপেক্ষায় আগাম অস্ত্র এনে রাজধানীর কাছে জমা করছে কি না, সেটাই বা কে বলবে!

উপরোক্ত সন্দেহ ও প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধান বের করতে পারলে হয়তো অবৈধ ওই সব বিশাল পরিমাণ অস্ত্রের মূল হোতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতে পারে। দ্বিতীয়ত, কী পরিমাণ এ রকম অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে আছে তা সঠিকভাবে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে একটু পেছনের দিকে তাকালে কিছুটা অনুমান করা যাবে হয়তো। ঢাকার উপকণ্ঠে এ রকম বড় অস্ত্রভাণ্ডারের মজুদ লুকিয়ে রাখা এবং তা উদ্ধারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৬ সালের ১৮ জুন উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকার একটি খাল থেকে প্রায় একই রকম বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার হয়; যার মেক অ্যান্ড টাইপ ও মডেল একই। নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিশ্লেষণ ও তদন্তের মৌলিক গাইডলাইনের কথা হলো, এ রকম একটি-দুটি বড় মজুদের অস্ত্রের সন্ধান পাওয়ার পর নিরাপত্তার স্বার্থেই ধরে নিতে হয় একই রকম অস্ত্রের ভাণ্ডার হয়তো আরো অনেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় ও কৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। শঙ্কা বাড়ছে তখনই, যখন দেখছি দিয়াবাড়ী এলাকা থেকে অস্ত্র উদ্ধারের পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও এর নেপথ্যের গডফাদার, নেটওয়ার্ক ও ষড়যন্ত্রকারীদের সামান্যতম কোনো ক্লু এ পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। ২ জুন পূর্বাচল ও গত বছর দিয়াবাড়ী এলাকা থেকে অস্ত্র উদ্ধারের আগে বিভিন্ন সময়ে আরো অনেক জায়গা থেকেও বড় বড় অস্ত্রের মজুদ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়ায় তখন ধারণা হয়, হতে পারে এগুলো ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র। কিন্তু রাজধানীর সন্নিকটে অস্ত্রের মজুদ অবশ্যই ভিন্ন বার্তা দেয়।

২০১৪ সালে হবিগঞ্জের সাতছড়ি উদ্যানে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, তারপর খাগড়াছড়ি এবং ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেরপুরের দুর্গম পাহাড়েও একই রকম বড় অস্ত্রের ভাণ্ডার পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের প্রকারভেদ একই রকম এবং এর প্রায় সবই এখনো ব্যবহারের উপযোগী। এ পর্যন্ত পাওয়া অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নকে সজ্জিত করা সম্ভব। আর যা এখনো পাওয়া যায়নি বলে সন্দেহ করা হয় তার পরিমাণ কত হতে পারে, তা ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়। এসব অস্ত্র বাংলাদেশে কিভাবে এলো ও কারা এর পেছনে আছে তার সব কিছু উদ্ঘাটন করার জন্য বিগত দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্র ধরে এগোতে হবে। আসামের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য আনা দশ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ধরা পড়ে। এ সম্পর্কিত মামলায় বিচারিক আদালতের রায় ও মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য মতে, ওই অস্ত্রের চালানের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা জড়িত, যাঁদের কয়েকজনকে আদালত গুরুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। যেভাবে অস্ত্রের ওই বিশাল চালানটি আনা হয়েছিল, তা সহজে ধরা পড়ার কথা নয়। কিন্তু হঠাৎ করে আকাশ থেকে নাজিল হয় পুলিশের দুই নাছোড়বান্দা সদস্য—সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন ও আলাউদ্দিন। বেরসিক দুই সার্জেন্টের কারণে সব কিছু উল্টে যায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যাঁরা ওই অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সবাই ওই ঘটনার পর আরো দুই বছর নিজ নিজ পদে বহাল ছিলেন। সুতরাং সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক যে তাঁরা ওই দুই বছরে আরো অস্ত্রের চালান এনেছেন। তাহলে সেসব অস্ত্র কোথায় গেল, এখন কোথায় আছে? ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ এখন বন্ধ এবং ওই সব সশস্ত্র গ্রুপের এখন তেমন কার্যক্রম নেই। এই হিসাব মেলালে ও তার সূত্র ধরে এগোলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে।

এখন যে অস্ত্রগুলো পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গে চট্টগ্রামে ধরা পড়া দশ ট্রাক অস্ত্রের অনেক মিল আছে। দেশের প্রধান ও প্রায় সর্বোচ্চ পঠিত একটি পত্রিকায় ২০১১ সালের ৮ আগস্ট ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসের বরাতে উলফাপ্রধান অরবিন্দ রাজখোয়ার সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ ছাপা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসকে রাজখোয়া বলেন, পাকিস্তান সরকারের ভেতরে থাকা উগ্রপন্থী একটি অংশ উলফাকে অস্ত্র সরবরাহ করত এবং সেগুলো বাংলাদেশ হয়ে আসামে ঢুকত। রাজখোয়া আরো বলেন, অস্ত্রের বড় একটি চালান ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ধরা পড়লেও অস্ত্র আনার ক্ষেত্রে তাঁরা বেশির ভাগ সময়ই সফল হয়েছেন। উলফাপ্রধান রাজখোয়াসহ অন্য সিনিয়র নেতারা ধরা পড়লেও তাঁদের সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়া এখনো গোপন স্থান থেকে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাতে বাংলাদেশের প্রিন্ট ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের জামায়াতের ক্যাডার বাহিনীর জন্য অস্ত্রের ব্যবস্থা করতে উলফার পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি ওই বছরের ১৫ অক্টোবর শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলার ইকো পার্কে কয়েকজন জামায়াত-বিএনপি নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে জামায়াত নেতারা ছোট অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার জন্য উলফার প্রতিনিধিদের কাছে আগাম হিসেবে ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র-সরঞ্জামাদি সরবরাহের প্রধান হোতা যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, তা এখন সর্বজনবিদিত এবং উলফাপ্রধান রাজখোয়াও তা অকপটে বলেছেন। আর ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের কারা স্বাধীনতাকামী বলে এবং পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, সে কথাও এখন দেশের ও বিদেশের সব রাষ্ট্র ও মানুষ জানে। বাংলাদেশের জঙ্গি, মিয়ানমার সীমান্তের রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী, ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী, তাদের সবার পৃষ্ঠপোষক ও অস্ত্রের জোগানদাতা ওই একই পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারি গোষ্ঠী। সুতরাং এই জঙ্গি সন্ত্রাসীদের যেকোনো এক গ্রুপের হাতে অস্ত্র এলে তা অন্য গ্রুপের কাছে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। ২০১৬ সালের ১২ মে কক্সবাজারের নয়াপাড়ার রোহিঙ্গা আনসার ক্যাম্প থেকে অস্ত্র লুট ও আনসার কমান্ডার আলী হোসেন নিহত হন। রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সঙ্গে ওই হামলায় নেতৃত্ব দেন পাকিস্তানের নাগরিক ওমর ফারুক।

তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) বেশ কয়েকজন জঙ্গি বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলে আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর প্রাক্কালে জামায়াত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, তাদের নেতাদের শাস্তি দেওয়া হলে দেশে গৃহযুদ্ধ বাধবে এবং তার জন্য তাদের বিশাল বাহিনী প্রস্তুত আছে। এরপর ২০১৫ সালের প্রথম দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে একনাগাড়ে দীর্ঘদিন অবরোধ চলাকালে দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াও ও সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণের হিড়িক দেখে কি সন্দেহ হয়নি যে তখন গৃহযুদ্ধ বাধানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল। ভিন্ন কৌশলে ভিন্ন পরিস্থিতির অজুহাতে আবার যে সে রকম চেষ্টা হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? সুতরাং রাজধানীর উপকণ্ঠে যখন এ রকম ব্যবহারের উপযোগী বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার পাওয়া যায় তখন সন্দেহ ও শঙ্কা দুটিই শান্তিকামী মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]