খােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০১৭: কারোর বেদনায় অন্য কারোর উৎসব থেমে থাকুক, কেউ চান না। আমিও চাই না অযথা মন খারাপের গল্প বলে কারোর আনন্দময় মুহূর্তগুলো নষ্ট করে দিতে। এই যে ‘অযথা’ শব্দটা বলে ফেললাম, আসলেই কি তা অযথা? একা কি ভালো থাকা যায় কখনো? সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার বিকল্প কি সত্যিই আছে? খুব ইচ্ছে হচ্ছিল- এবারের ঈদে যদি ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি খাবার আর ছোট ছোট শিশুদের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে চলে যেতে পারতাম বিধ্বস্ত পাহাড়ী এলাকায় অথবা হাওরের নিঃস্ব মানুষগুলোর কাছে! সেই ইচ্ছে আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। আচ্ছা সরকারের পক্ষে এই কাজটা করা কি খুব অসম্ভব কিছু ছিল? হয়তো অসম্ভবই বটে। হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে তিন লাখ কৃষক পরিবার আর রাঙামাটিসহ বিধ্বস্ত পাহাড়ী এলাকায় আরও কয়েক লাখ মানুষ। এতো মানুষকে একদিনে ভালো খাবার আর লাখ লাখ পোশাক দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সত্যিকারের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলে পরিকল্পিতভাবে হয়তো তাও সম্ভব ছিল। সমাজের বিত্তশালীরা অবশ্যই পারতেন স্বপেরœ একটা বড় অংশ পূরণ করতে, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারাও পারতেন এক হয়ে কাজ করলে। যদিও এর সবটাই এদেশে অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা যারা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বড় বড় নীতি কথা বলি, চায়ের টেবিলে ঝড় তুলি, তাদের সবাই কি যার যার অবস্থান থেকে খানিকটা উদ্যোগী হয়ে কিছু মানুষের মুখে ঈদের দিন অন্তত এক বেলার ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতাম না! পারতাম হয়তো, কিন্তু ভেবেই যে দেখা হয়নি।
ভারী মাটির চাপায় কাঁদছে রাঙামাটি আর অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের ঈদ আনন্দ। ঘর থেকে ঘরে বইয়ে যাওয়া লাশের গন্ধ এখনো মিলিয়ে যায়নি। মা-বাবাকে হারিয়ে যে শিশু এখনো বেঁচে আছে, তার আবার ঈদ কিসের! সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন যখন যৎসামান্য ত্রাণ নিয়ে গেছেন এর আগে, তাদের কাছে বিপর্যস্ত মানুষগুলো হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কেবল দু-মুঠো খাবার আর আহত আপনজনের চিকিৎসার জন্য। হাওরের যে কৃষক এক ফসলি জমি থেকে দেড়শো থেকে দুইশো মণ ধান পেয়ে থাকেন প্রতি বছর, গত এপ্রিলের অকাল বন্যায় সব তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও পাননি এবার। এবার ঈদে সেই প্রান্তিক কৃষক পারেননি সন্তানের জন্য কোনো নতুন পোশাক কিনতে। দুই বেলা খাবারের অনিশ্চয়তার মুখে এলাকা ছেড়েছেন এমন হাজার হাজার কৃষক। অন্য এলাকায় গিয়ে খুঁজছেন দিনমজুরের কাজ। পরিবারের সাথে তার ঈদ করার ভাবনা তো সেখানে বিলাসিতা।
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে জানি, এবার ঈদের বেচা-কেনায় ব্যবসায়ীরা বেশ খুশি। অর্থাৎ আমি-আপনি আমরা সবাই মিলে যার যার পরিবারের সবার জন্য খুশি মতো কেনাকাটা করেছি ঈদ উপলক্ষে। কে কোন পাহাড়ে, কে কোন হাওরে না খেয়ে রইল অথবা চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারল কি না তা ভেবে যে কাজ নেই কারোর। প্রায় দুই যুগ আগে কোনো এক জাতীয় পত্রিকার একটা উপসম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল, ‘উত্তরবঙ্গে মঙ্গা, ঢাকায় লাখ টাকার লেহেঙ্গা’। সেই চিত্র কখনো পুরানো হয় না। আজও সেই একই চিত্র এই সমাজে।
ঈদ যাচ্ছে যাক, জীবনের মৌলিক চাহিদার কাছে উৎসবের জন্য হয়তো ওদের কোনো আক্ষেপ নেই। কষ্ট রয়েছে বর্তমান সময়ের প্রতিটা দিনের জন্য দু-মুঠো খাবারের। সবাই জানি, পাহাড় কিংবা হাওরের দুর্যোগ কাটিয়ে দুর্গত মানুষেরা আবার উঠে দাঁড়াবেন, স্বজন কিংবা স্বপ্ন হারানোর কষ্ট ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করবেন যুদ্ধরত মানুষগুলো। তাদের এখনকার কষ্টগুলো হয়তো খুব নিরবে ছুঁইয়ে যাবে কখনো কখনো। সময়ের প্রলেপে তারা হেসে উঠবেন খুব সহজে, যতটা কঠিন আত্মকেন্দ্রীক এই আমাদের জন্য তাদের পাশে দাঁড়াবার। কারণ ওরা সত্যিই ভালো থাকতে জানে, জানি না কেবল আমরা।
তাই, বিধ্বস্ত পাহাড়ী জনপদ আর বিপর্যস্ত হাওরাঞ্চলের মানুষের পক্ষ থেকে ঈদের আন্তরিক শুভেচ্ছা সবাইকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান