Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

17kমঞ্জুরুল আলম পান্না।।খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭: উত্তপ্ত দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণ। বেশ কয়েকদিন ধরে যৌথ প্রযোজনার ছবির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতিসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ১৬টি সংগঠনের জোট চলচ্চিত্র শিল্প পরিবার বলছে, যৌথ প্রযোজনার নামে চলছে যৌথ প্রতারণা। তারা মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়কে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখভালের বিষয়টি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের না হয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এমনটি পৃথিবীর সম্ভবত আর কোনো দেশে নেই।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ছবি নির্মাণ শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে প্রখ্যাত নির্মাতা আলমগীর কবিরের পরিচালনায় ‘ধীরে বহে মেঘনা’র মাধ্যমে। একই বছর ভারতের কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এরপর প্রায় একশ ছবি নির্মিত হয়েছে এই দুই দেশের যৌথ প্রযোজনায়। প্রথম দিকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর একে অপরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নির্মিত হয়ে আসছিল যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো। তারপরও বিষয়টিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকার একটি নীতিমালা তৈরি করে। নীতিমালাটির বিষয়ে বিশেষ কোনো মহল থেকে কোনো আপত্তি না থাকার পরেও ২০১২ সালে আরেকটি নীতিমালা তৈরি হয়, যেটির সংশোধিত কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার অভিযোগ চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের। তবে আগের নীতিমালাসহ ২০১২’র নীতিমালার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে দুই দেশের শিল্পী ও কলাকুশলীর সংখ্যানুপাত সাধারণভাবে সমান রাখতে হবে। চিত্রায়নের ক্ষেত্রে দুই দেশের স্পট সমান প্রাধান্য পাবে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এই নীতি উপেক্ষিত হচ্ছে চরমভাবে। যৌথ প্রযোজনার প্রায় সব ছবিতে এখন দেখা যাচ্ছে ভারতের শিল্পীদের আধিক্য এবং একইভাবে শ্যুটিং-এর বেশিরভাগই হচ্ছে ভারতে।
যেমন- যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবি ‘ব্লাক’ মুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তি ছিল- একই সময়ে দুই দেশে ছবিটি মুক্তি দেওয়ার। কিন্তু কলকাতার প্রযোজনা সংস্থা দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড চুক্তি ভঙ্গ করে বাংলাদেশের প্রযোজককে না জানিয়ে একতরফাভাবে কলকাতায় ছবিটি মুক্তি দেয়। এতে করে বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বছর তিনেক আগে মুক্তি পাওয়া ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবিটিতে নায়ক-নায়িকা কেউই বাংলাদেশের ছিলেন না। রোমিও বনাম জুলিয়েট-এর পোস্টারে কোনো পরিচালকের নামই ব্যবহার করা হয়নি। কোনো কোনো ছবির ক্ষেত্রে দেখা গেছে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত আর ব্যাংকক বা অন্য কোনো দেশে ছবির শ্যুটিং শেষ করা হলেও তাতে বাংলাদেশের কোনো স্পটের নাম-গন্ধ নেই। এ ধরনের অভিযোগ যখনই উঠেছে তখনই ভারতীয় প্রযোজকরা তাদের প্রতারণা ঢাকতে লোক দেখানো কায়দায় শেষমেষ দু-একটি গানের শ্যুটিংয়ের আয়োজন করেছে এদেশে। এর সবই বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিকর।
যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মূলত এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সাংস্কৃতিক ভাবনার আদান-প্রদান। তা আর হচ্ছে কোথায়? বাংলাদেশের অনেক কিছুতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রভাব বিস্তারের তালিকায় রয়েছে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। দেশটির শতশত স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাদেশে অবাধে প্রবেশ করলেও সেদেশে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এ নিয়ে দীর্ঘদিন বিতর্ক চললেও অবস্থা আগের মতোই। একইভাবে যৌথ প্রযোজনার নামে আসলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাজার দখল করে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ছবি। আর এক্ষেত্রে ফায়দা লুটছে এদেশেরই দু-একটি প্রযোজনা সংস্থা। পাশাপাশি অভিযোগ রয়েছে যৌথ প্রযোজনার আড়ালে ভয়াবহ রকম অর্থ পাচার করা হচ্ছে ভারতে। অর্থ প্রচারের জন্য এর চেয়ে সহজ মাধ্যম না কি এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। একইসঙ্গে এ ধরনের ছবি থেকে অর্জিত লভ্যাংশের ওপর নির্ধারিত রাজস্ব সংশ্লিষ্ট দুই দেশের সমানভাবে পাওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের ছবির মান নি¤œতার শেষ পর্যায়ে নেমে গেছে। নেই ভালো কোনো কাহিনী বা স্ক্রিপ্ট, সম্পাদনা নি¤œমানের, শ্যুটিং স্পট যাচ্ছে না তাই, রয়েছে ভালো শিল্পীর অভাব, নেই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। তাই হলো বিমুখ দর্শক। অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, প্রায় দেড় হাজার সিনেমা হলের এক একটি করে বন্ধ হতে হতে তার সংখ্যা এখন ঠেকেছে মাত্র চারশোতে। পাশাপাশি পরিচালক সমিতি, সেন্সর বোর্ডসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগও কম নয়। কাজের কাজ কিছু না করে চাঁদাবাজির অনেক পুরনো অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। তবে এসবকে কারণ দেখিয়ে যারা কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন তাদেরকে বরং অন্য কারোর দালাল বলেই মনে হয়। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলাটা কোনো যুক্তি নয়। অনেক দুর্দশার মধ্যেও এদেশে এখনো সত্ত্বা, মনপুরা, আয়নাবাজি, জিরো ডিগ্রির মতো বাণিজ্যিক ছবি তৈরি হয়। আর এর দর্শকও সব শ্রেণির। সঠিক নিয়মনীতি মেনে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের পাশাপাশি বরং আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আন্তরিকতার সঙ্গে তার সমাধানের রাস্তা বের করাটা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক