Mon. Apr 21st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
1501903855
খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৭: অন্ধকারে দেখা যায় না ভাল। গেট দিয়ে ঢুকলে বামে অফিস রুম। তার বাইরে পুরোটাই ফ্যাক্টরি। দূরে এক কোণে কয়েকজন নারী কাজ করছেন। এক সময়ে শ্রমিকদের আনাগোনায় গমগম করতো ঢাকার নবাবগঞ্জের হোসেন উদ্দিন খান দ্বিতীয় লেনের এই ভবনটি। এখন সেই রমরমা অবস্থা আর নেই।
সাকিব এন্টারপ্রাইজ একসময়ে দেশে কাচের চুড়ি বানানোর সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ছিল। ম্যানেজার আবুল কাশেম বললেন, গত দুই বছরে আমরা কোন চুড়ি বানাইনি। যা স্টকে ছিল সেসব এখনও শেষ হয়নি। এবছরে শেষ হবে বলেও মনে হয় না। কাচের চুড়ি আর চলে না। রেশমি চুড়ির সোনালী দিন হারিয়েই যাচ্ছে।
অথচ কাচের রেশমি চুড়ির এক স্বর্ণালী ইতিহাস রয়েছে। রেশমি চুড়ি বাঙালি নারী-পুরুষের কাছে রোমান্টিকতার প্রতীক। এখনো উত্সবে পার্বণে শখের বসে অনেক মেয়েই কাচের চুড়ি কেনেন। ছেলেরা কেনে তার প্রিয় মানুষের জন্য। ছেলে ও মেয়েদের চুড়ি পরার ইতিহাস অনেক দিনের। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ২ হাজার ৬০০ বছর আগের। এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, প্রাচীনকাল থেকে চুড়ি পরছে মানুষ। নিছক অলংকার হিসাবে নয়। সেসময় চুড়ি নারী-পুরুষ সবাই পরতো। চুড়ি কোন কোন সমাজে সামাজিক অবস্থানের প্রতীক হিসাবেও বিবেচিত হতো।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে চুড়ির ব্যবহার দক্ষিণ এশিয়ায় হরপ্পা সভ্যতার আগে থেকেই শুরু হয়। চুড়ি তৈরির উপাদান হিসাবে লোহা, ব্রোঞ্জ, কপার, স্বর্ণ, রৌপ্য, শঙ্খ, পোড়ামাটি, পাথর, হাড়সহ বিভিন্ন স্বল্পমূল্যের পাথর, দামি পাথর আর বিচিত্র অলঙ্করণের উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার চুড়ির একটি অন্যতম আদি নিদর্শন হিসাবে সবচাইতে বিখ্যাত হচ্ছে মহেনজোদারোতে পাওয়া নৃত্যরত বালিকার ধাতব ভাস্কর্যটি। এই ভাস্কর্যে বালিকা নগ্ন হলেও তার একটি হাত বাহুমূল থেকে কব্জি পর্যন্ত চুড়ি পরিহিত। বর্তমানে রাজস্থানে নারীদের একই রীতিতে চুড়ি পরিধানের প্রবণতা রয়েছে।
ভাস্কর্য, বিভিন্ন প্রাচীন লেখা নথি, কাব্য, নাটক, চিত্র ইত্যাদিতে বিচিত্র ধরনের চুড়ি পরার ধরন, কারণ ও প্রেক্ষাপটের কথা আমরা জানতে পারি। শাসক বা উচ্চশ্রেণির পুরুষ ও নারীগণ দামী ধাতুর ও অলঙ্কৃত চুড়ি পরতেন। আর অন্যরা স্বল্প দামী ও সহজলভ্য উপাদানে বানানো চুড়ি পরতেন। আবার বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার, অনুষ্ঠান ও আঞ্চলিকতার পরিপ্রেক্ষিতে চুড়ি ব্যবহারের অর্থ ও তাত্পর্য বদলায়। অনেক জায়গায়ই বিবাহিত নারীরা একটি লোহার চুড়ি পরিধান করেন। বাংলার হিন্দু সধবাগণ শাখা পরিধান করেন। শিখ পুরুষরা একটি লোহার বালা পরেন। ফুলের তৈরি চুড়ি সদৃশ সজ্জার উল্লেখও পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, কেবল নারীরাই চুড়ি পড়বে বা পড়েন, কিংবা কেবল বিশেষ ধর্মের, শ্রেণির বা জাতিবর্ণের নারীরাই চুড়ি পড়েন এমন ধারণা ভ্রান্ত। বরং আদি দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ও পুরুষ নির্বিশেষেই চুড়িসহ নানা ধরনের অলংকার পরার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে চুড়ি কেবল সৌন্দর্যের জন্য পরা হয় এমন ধারণাও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ও সমাজ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
আধুনিকতার স্রোতে কাচের চুড়ির বিক্রি কমে গেলেও এর আবেদন কিন্তু এখনো ফুরিয়ে যায়নি একেবারে। বিবাহিত মেয়ের প্রতীক হিসেবেই শুধু নয় বাঙালিদের উত্সবে, অনুষ্ঠানে কাচের চুড়ি হচ্ছে অন্যতম উপকরণ। হাতে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ না হলে যেন শাড়ি-সাজ পূর্ণতা পায় না। এই চুড়ি নিয়ে কত শত গান হয়েছে। ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’র মতো সেসব বিখ্যাত গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
‘চুড়ি রাখবেন, চুড়ি?’ মাথায় করে চুড়ি ভর্তি ডালা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চুড়ি বিক্রেতাদের এখন কালেভদ্রে দেখা মেলে। তারপরেও শাহবাগে চারুকলার সামনে ডালা নিয়ে দোকানিদের সামনে গিয়ে ঠিকই হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যায় তরুণীদের। এছাড়া পহেলা বৈশাখ, পৌষ মেলাসহ বিভিন্ন উত্সবে রংবেরংয়ের চুড়ি পাওয়া যায়। তবে রাজধানীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চুড়ির পসরা বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ, ইডেনসহ বিভিন্ন কলেজের সামনে। কাচের চুড়ির দাম খুব কম। ডজন প্রতি চুড়ি ৪০ থেকে ৮০ টাকা। খাঁজকাটা চুড়ির দাম ৬০  থেকে ১০০ টাকা। জরি চুমকি বসানো রেশমি চুড়ির দাম সাধারণ কাচের চুড়ির তুলনায় খানিক বেশি।
পুরানে ঢাকায় গয়নার পাশাপাশি চুড়ির পাইকারি বাজার রয়েছে। একসময় খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। সেই পথ ধরেই চবাজারের কাছে সেই চুড়ি বাজারের নাম হয় ‘চুড়িহাট্টা’। তবে দেশি চুড়ির বাজার দিন কমে যাচ্ছে। চুড়ি বানানোর বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সেইসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান যারা একসময় কাচের রেশমি চুড়ি রং করে জরি চুমকি বসিয়ে বাজারে দিত তারাও ব্যবসা বদলে অন্য ব্যবসায় চলে এসেছেন। কেউ কেউ শুরু করেছেন মেটালের ওপরে জয়পুরী নকশার চুড়ি বানানো। এখন মেয়েদের পছন্দের শীর্ষে থাকা জয়পুরী চুড়ি বানাচ্ছেন তারা। কামরাঙ্গিরচরে কুড়ার ঘাটের পাশে চুড়ি নির্মাতা নোকিয়া ফ্যাশনের ফ্যাক্টরি। এর স্বত্বাধিকারী মো. মিজানুর রহমান বলেন, কাচের চুড়ি বলেন আর মেটালের চুড়ি কোনটারই ব্যবসা নাই। ভারতীয় ও চীনের গয়নার চাপে আমাদের মত শত শত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে।
চুড়ির ইতিহাস: ইংরেজিতে চুড়িকে বলা হয় ব্যাঙ্গেল (bangle), এই শব্দের উত্পত্তি বাঙ্গারি (bangari) থেকে। যার অর্থ কাচ। এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় নৃত্যরত বালিকার মূর্তিতে চুড়ি দেখা  গেছে। প্রথমে মাটি, পরে লোহা, তামা  ব্রোঞ্জ, সোনা-রূপা নানা ধাতুতেই চুড়ি পরার চল ছিল। এখনও রয়েছে। হাল আমলে এসে চুড়ির ডিজাইন ও উপকরণ আরো বেড়েছে। তবে খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার হাজার বছর আগে রোমান সভ্যতায় চুড়িতে কাচের ব্যবহার শুরু হয়। তখন চুড়ির উজ্জ্বলতা বাড়াতে ব্যবহার করা হতো। এরও প্রায় এক হাজার বছর পরে রোমানরা কাচের  চুড়ি বানানো শুরু করে।
চুড়ির ইতিহাসের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন  প্রত্নতাত্বিক অ্যান্ড্রু ললার। এক প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, কম্বোডিয়ান বাদকদলের সঙ্গে নাচিয়ে মেয়ের চুড়ি পরা হাতের দিকে আমার চোখ আটকে গেল। কারণ কয়েকদিন আগেই এই রকম চুড়ি আমি দেখেছি। তবে কম্বোডিয়ার কোন সমভূমিতে নয়, উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডের প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়। সেখানে এক নারীর হাতে জড়িয়ে আছে অনেক চুড়ি, সে জীবিত নয়। প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। তবে তার ফসিলের হাতে চুড়িগুলো লেপটে আছে। তিনি আরও লিখেছেন, এর থেকেই বোঝা যায় ১২শ’ শতাব্দীর কম্বোডিয়ার অ্যাঙ্কর ওয়াট মন্দিরের খেমার কারিগরদের পাথর খোদাইয়ে অনেক আগেই চুড়ি পরা হাতের ছোঁয়া লেগেছিল। এই চুড়ি থেকে আন্দাজ করা যায়, ভারত ও চীনের মানুষেরা এখানে আসার আগেই অ্যাঙ্করের অধিবাসীরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উন্নত ছিল।
ভারতের বিবাহিত মেয়েদের অন্যতম অলঙ্কার হচ্ছে চুড়ি। এই চুড়ি পরাতেও রয়েছে এলাকাগত ঐতিহ্য। পাঞ্জাবের মেয়েরা বিয়ের ২১ দিন পর্যন্ত হাতির দাঁতের চুড়ি পরে। তবে কেউ কেউ পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এক বছর ধরেও পরে থাকে এই চুড়ি। রাজস্থানের মেয়েরা কবজির উপরে পরে হাতির দাঁতের চুড়ি। বাকি হাতজুড়ে থাকে সোনার কাঁকন। স্বামী যতদিন জীবিত থাকে ততদিন এভাবে পরে থাকতে হয়। যদিও আধুনিক যুগে এখন আর এই প্রচলন নেই। ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলের মেয়েরা যেখানে সোনার চুড়ি পরছে সেখানে পশ্চিম বাংলার বিবাহিত হিন্দু মেয়েরা সাদা শাখার সঙ্গে পরছে কোরাল লাল রংয়ের চুড়ি।
রং দেখে যায় চেনা:রঙিন কাচের চুড়ির বিভিন্ন রকম মানে রয়েছে। লাল চুড়ির অর্থ ক্ষমতা। নীল চুড়ি জ্ঞান। বেগুনি চুড়ি স্বাধীনতা। সবুজ চুড়ি বিবাহিত। হলুদ চুড়ি সুখী। কমলা চুড়ি সাফল্য। সাদা চুড়ি নতুন করে শুরু। কালো চুড়ি শক্তি। রূপালি চুড়ি তেজ। আর সোনালি চুড়ি হচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক।