গাজীউল হাসান খান: খােলা বাজার২৪।।বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭: বাংলাদেশে কিছু রাজনীতিক ও কূটনীতিক রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন তাঁরা যমের কথা না ভাবলে যম তাঁদের ছেড়ে দেবে। অর্থাৎ তাঁদের ঘাঁটাবে না। নতুবা ১৯৭৮ সাল থেকে বার্মার তৎকালীন সামরিক জান্তারা তাদের মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন প্রদেশের মানুষের ওপর নতুন যে হামলা ও নির্যাতনের সূচনা করেছিল, আজও তার কোনো সমাধান হলো না কেন? রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালানো ও সেখান থেকে তাদের বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঠেলে দেওয়ার কারণে ১৯৭৮ সালেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করেছিল। কিন্তু তাতে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হলেও বার্মার সামরিক জান্তারা বিষয়টি মোটেও ভুলে যায়নি। তারা সময় ও সুযোগ মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়নের জন্য বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন ও হামলা চালিয়ে গেছে। দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকেও রাখাইন প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে। আজ সেই পুরনো ব্রহ্মদেশ বা বার্মা ‘মিয়ানমার’ হিসেবে নতুন নাম নিয়ে বিশ্বসমাজে আবির্ভূত হলেও তারা তাদের অতীত ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’ বিদ্বেষ ভুলে যায়নি।
সময়ের ব্যবধানে মিয়ানমারে সরাসরি সামরিক শাসনের অবসান এবং একটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো চালু করা হলেও সেখানে সামরিক শক্তি কিংবা অধিনায়কদের প্রভাব কমে যায়নি। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি তাঁর দেশের সর্বশেষ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ কিংবা রাজনৈতিকভাবে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেও পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করেননি। নোবেলজয়ী সু চির দল ক্ষমতায় এসেছিল শর্ত সাপেক্ষে। তা ছাড়া তাঁর হাতে দেশ পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি।
সে অবস্থায় পর্দার অন্তরালে থেকে সামরিক শক্তি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা বা কর্মসূচি নিয়ে সময় ও সুযোগ মতো মাঠে নেমেছে। ঘটনাটি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির কাছে বারবার তুলে ধরা হলেও তিনি তার যথাযথ সমাধানের পথ না দেখিয়ে নিজেই বিতর্কিত পথে হাঁটার প্রয়াস পেয়েছেন। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের কারো কারো ধারণা, এ বিষয় নিয়ে সামরিক চক্রের বিরোধিতা করলে তিনি (সু চি) শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা হারাতে পারেন। এবং এমনকি সু চির বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে যাওয়াও অবিশ্বাস্য হবে না।
Trending Topics Worldwide
মিয়ানমারের অর্থসম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী সামরিক শক্তি (বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত চক্র) বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী রাখাইন প্রদেশে একটি বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে তুলতে বিশেষভাবে আগ্রহী। তা ছাড়া চীন সেখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করার আশ্বাসও এরই মধ্যে দিয়েছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে চীন ও ভারত সেখানে প্রতিযোগিতামূলকভাবে তাদের কর্মকাণ্ডের দ্রুত বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করছে। সে কারণেই চীন ও ভারত রাখাইন প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলিম বা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ কিংবা অধিকারের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গাদের শাসানো শুরু করেছে। ক্রমাগতভাবে নির্যাতিত ও আক্রান্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে কোনো ন্যায়সংগত কথা এ পর্যন্ত শোনা যায়নি। অথচ ভারত ও চীন উভয়েই মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশেরও প্রতিবেশী। উভয় দেশ বাংলাদেশের বহু উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এ পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষের মধ্যে চীন ও ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিতেই পারে।
কিছুদিন আগেই চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় একটি সর্বনাশা বন্যা হয়ে গেছে। তার রেশ এখনো কাটেনি। এখনো দেশব্যাপী পুনর্বাসন কিংবা রাস্তাঘাট মেরামতের কাজও শুরু হয়নি। এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ ও সাহায্য-সহযোগিতা। সে অবস্থায় প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে থেমে থেমে যদি এভাবে লাখ লাখ বিপন্ন মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশ কার কাছে সাহায্য চাইবে? মিয়ানমারের সামরিক শাসকগোষ্ঠী অতীতে দীর্ঘদিন ধরে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ‘রাজ্যহীন বাঙালি মুসলমান’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ এই জনগোষ্ঠী রাখাইন রাজ্যে বাস করছে কয়েক শ বছর ধরে। ১৬৬৬ সালে মোগল সম্রাটরা চট্টগ্রাম দখল করার পর জনগোষ্ঠীটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজও বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে রাখাইন রাজ্যে ৮০ থেকে ৯৬ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান বসবাস করছে। রাখাইন জনগোষ্ঠীকে ১৯৭৪ সালে বার্মার সাবেক শাসক জেনারেল নে উইন আরাকান রাজ্য থেকে পৃথক করে একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। এর পর থেকে রাখাইন অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সঙ্গে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়েছিল, যার পেছনে ছিল মূলত সামরিক শাসকগোষ্ঠী। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে, তাতে উভয় পক্ষে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছিল। রাখাইন রাজ্যের ৩০ লক্ষাধিক নাগরিকের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা স্বাধীনতা পেলে রাখাইন অর্থাৎ এই রাজ্য (আরাকান) তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় বলে পরিচিত হলেও মিয়ানমারের সাবেক শাসকগোষ্ঠী ও একটি বিশেষ মহল সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের মেনে নিতে পারেনি। তারা দফায় দফায় আক্রমণ চালিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে তাদের বসতবাড়ি ও দোকানপাট। স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এমনকি মসজিদ পর্যন্ত তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ১৯৭৮ সাল থেকে উল্লিখিত এ সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও হামলা ক্রমে ক্রমে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। অথচ এখনো প্রতিবেশী বাংলাদেশের সরকার বলছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমার সরকারকেই সমাধান করতে হবে। সব কিছু বুঝে-শুনে এ ধরনের কথাবার্তা বলছিল বাংলাদেশ! আমরা জানি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক মহল ও জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাই বলে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। তা ছাড়া ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশের কোনো সরকারই বিষয়টির একটি স্থায়ী কূটনৈতিক কিংবা সামরিক সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষ কোনো ফলপ্রসূ ব্যবস্থাই নেয়নি। সবাই যেন নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলেছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের হত্যা কিংবা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বাইরে যেতে পারেনি। রাজনীতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকুক আর না-ই বা থাকুক, উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার কৌশল জারি ছিল দীর্ঘদিন।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যা সমাধান নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও প্রচুর আলোচনা হয়েছে। এত দিন নির্যাতিত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রও বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসেনি। এখন এসেছে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া। পর্যায়ক্রমে হয়তো আরো অনেকে এগিয়ে আসবে। তা ছাড়া এ বিষয় নিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে অত্যন্ত গভীরভাবে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তাতেই মিয়ানমারের নেতৃত্ব কিংবা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সব কিছু মেনে নেবে—তা মনে করার মোটেও কোনো কারণ নেই। ছিন্নমূল ও উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশকে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে সেনা ও নৌবাহিনীর শক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন থেকে সাবমেরিন ক্রয় করার পর এর প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে যাঁরা বিভিন্ন বিতর্কের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তাঁরা এখন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন বলেই অনেকের ধারণা।
দেখা যাক মুসলিম বিশ্ব ও জাতিসংঘ এ জরুরি বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে কিভাবে ও কতটুকু এগোয়। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের কাছ থেকে বন্ধুসুলভ কিংবা প্রতিবেশীসুলভ কোনো মানবতাবাদী আচরণ আশা করা যায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারা সম্পূর্ণ বিষয়টিকে ঝুলিয়ে দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করবে, যাতে রোহিঙ্গারা নিঃশেষ হয়ে যায়। তা ছাড়া জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সুপারিশের মতো তারা অন্যান্য কমিশনের রিপোর্টকেও অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করবে। সে অবস্থায় ব্যর্থ হতে পারে বিষয়টির নিষ্পত্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সব উদ্যোগ। তখন বাংলাদেশ কী করবে? ত্রাণ শিবির খুলে বছরের পর বছর প্রতিপালন করবে রোহিঙ্গাদের? আর সে সুযোগে কিংবা সময়ের অবকাশে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রম, যা বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। এবং এ দেশকে আবার এক অসামাজিক কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠীর অভয়ারণ্যে পরিণত করতে পারে।
উল্লিখিত বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে আর কেউ বেশি বোঝেন বলে মনে করি না। তা ছাড়া বিষয়টি তিনি এরই মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করেননি, এমনও নয়। তাই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিকল্প চিন্তা ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কথাও ভাবতে হবে। চীন ও ভারত—বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমার, কারো কাছেই শত্রুভাবাপন্ন হতে চাইবে না। সুতরাং এ সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ বাংলাদেশের জন্য কোনটি হবে, তা আমাদেরই বেছে নিতে হবে।
লন্ডন থেকে
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক