খােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭:
ইসহাক খান
ওপরের শিরোনাম একটি জাতীয় দৈনিকের। মহাসড়কে বাস দুর্ঘটনায় নিত্যদিনের মৃত্যুর ঘটনায় শিরোনামটি ব্যবহার করে তারা। ঈদের সময় এই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয়। প্রতিদিন ১০-১৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। মহাসড়ক নিয়ে চালকদেরও অনেক অভিযোগ। রাস্তা খারাপ। খানাখন্দকে ভরা। গর্তে চাকা আটকে গাড়ি বিকল হওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটে। তার ওপর মহাসড়কে ধীরগতির যান চলে দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ঈদের সময় ব্যস্ত সড়কে সিএনজি, ভটভটি, টেম্পো, এমনকি রিকশা চলারও অভিযোগ শোনা যায়। সেসব দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারায় তাদের সেই মৃত্যু নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা হয় না।
হলেও রায় কী হয়, সেসব জানা যায় না। আর কোনো দুর্ঘটনায় যদি চালকের শাস্তি হয়, তাহলে দেশে ঝড় বইয়ে দেয় বাস শ্রমিকরা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিআরটিএ গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসালে গাড়িচালকরা সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। মহা দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা। সরকারও তাদের কাছে নতজানু। তাই তাদের বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর অভিযোগ আছে গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে। সে তুলনায় রাজধানীতে ধীরগতিতে গাড়ি চালায় গাড়িচালকরা। কারণ রাজধানীতে বেশির ভাগ সময় রাস্তায় জ্যাম থাকে। ইচ্ছা থাকলেও চালকরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে পারে না। সুযোগ থাকলে রাজধানীতেও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর একটি ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখলাম গত ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরে শেওড়াপাড়ায়। স্কুল থেকে ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন গৃহবধূ রিমা আক্তার। মেয়ে তিশা পড়ে রাজধানীর মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটে, পঞ্চম শ্রেণিতে। স্কুল ছুটির পর মায়ের সঙ্গে রিকশায় ফিরছিল তিশা ও তার ছোট ভাই তাহমিদুর আলম। মিরপুরের রোকেয়া সরণির লাইফ এইডের কাছে ঘটে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। রিকশা থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় মা রিমা আক্তার ও ছেলে তাহমিদুর আলম রাস্তা পেরিয়ে আইল্যান্ডে উঠতে সক্ষম হলেও তিশা পারেনি। সে আইল্যান্ডে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। আর তার মাথা থেঁতলে দেয় তেঁতুলিয়া পরিবহনের একটি বেপরোয়া গতির গাড়ি। ঘটনাস্থলেই তিশার মৃত্যু হয়। অবরোধের কারণেও দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। তখন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়াধাওয়ি চলে। উত্তেজিত জনতা তেঁতুলিয়া পরিবহনের কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করে পরিস্থিতি শান্ত করেন। এর আগে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কে প্রায় দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আহমেদ জানান, দুপুর ১টার দিকে তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাসটির চাপায় ঘটনাস্থলেই তিশার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় বাসটির চালক আব্দুর রহিম ওরফে বাবুকে আটক করা হয়েছে। মামলা প্রক্রিয়াধীন।
তিশার স্বজনরা জানায়, মিরপুরের পূর্ব কাজীপাড়ায় আলহেলাল হাসপাতালের কাছেই তিশাদের বাসা। তার বাবা খোরশেদ আলম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। খোরশেদ ও রিমা দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে তিশা বড়। স্কুল ছুটির পর তিশা মাকে বলেছিল, ‘মা, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। ’ মা মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘বাসায় চলো, বাসায় তোমাদের জন্য রান্না করে রেখে এসেছি। গিয়ে তোমাদের আগে খেতে দেব। ’
রাস্তা থেকে লাশ উদ্ধার করার পর ভ্যানের কাছে এসে মা রিমা আক্তার আহাজারি করে বলতে থাকেন, ‘আমার মেয়ের খিদে লেগেছে। ও খেতে চেয়েছিল। ওকে বাসায় খেতে দেব বলেছিলাম। আপনারা আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন। ও আল্লাহ…। ’ রিমা আক্তারের এই আহাজারিতে উপস্থিত তাঁর স্বজনরাও কান্নায় ভেঙে পড়ে। পথচারীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিল না। অনেকেই ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। চোখের সামনে আদরের সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু কোনো মা-বাবারই সহ্য হওয়ার কথা নয়।
পুলিশ স্থানীয় জনতাকে আশ্বস্ত করলেও জনতা জানে এই মৃত্যুর কোনো কূলকিনারা হবে না। বিচার হয়তো হবে। কিন্তু চালকের কোনো শাস্তি হবে না। এমন নির্মম মৃত্যু যেন তাদের নিয়তির লিখন। সেভাবেই মেনে নিয়েছে তারা। তাইতো দুর্ঘটনা ঘটলে উত্তেজিত জনতা গাড়ি ভাঙচুর করে। গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যেহেতু তারা জানে, তারা বিচার পাবে না। তাই তারা গাড়ি ধ্বংস করে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করে।
খোরশেদ-রিমা দম্পতির জীবনে যা ঘটল তা কি তাঁরা কোনো দিন ভুলতে পারবেন? সারা জীবন এই কষ্টের ক্ষত তাঁদের বয়ে বেড়াতে হবে। ব্যাপারটা গাড়িচালকরা যদি দয়া করে একটিবারের জন্য ভাবে, তাহলে তারা বুঝতে পারবে কত মা-বাবার বুকে প্রতিদিন অসহনীয় কষ্টের ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে তারা।
লেখক : গল্পকার, টিভি নাট্যকার