এ কে এম আতিকুর রহমান
খােলা বাজার২৪।।বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৭: গত ২৮ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শুরুতেই জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তিনি কফি আনানের নেতৃত্বে মিয়ানমার সরকারের মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত রাখাইন রাজ্যবিষয়ক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার কথা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও সেনা অভিযান বন্ধের আহ্বান জানান। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সহিংসতার তীব্র নিন্দা ও তা বন্ধ করা ছাড়াও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখার জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। অবিলম্বে মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত নেওয়ার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায়। রাখাইনে সব ধর্মের ও সম্প্রদায়ের লোকদের সহাবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখ করে।
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন রাখাইনে সব ধরনের সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেও মিয়ানমার সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানায়। রোহিঙ্গা সংকটকে জটিল উল্লেখ করে এর দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর সমাধান আশা করে। আর এ জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে। ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে চীন আশা প্রকাশ করে। আরেক সদস্য রাষ্ট্র ফ্রান্স আরাকানে সহিংসতা বন্ধ করা এবং মানবিক সহায়তা দেওয়ার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
ফ্রান্স আরাকানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান এবং আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে অবাধে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
আরেক স্থায়ী সদস্য রাশিয়া রাখাইন পরিস্থিতির অবনতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের প্রতি সহানুভূতি জানায়। তারা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে। তবে রাশিয়া আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়। অস্থায়ী সদস্য জাপান আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নসহ মানবিক সহায়তা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া ছাড়াও রাখাইনে সহিংসতা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলার নিন্দা জানায়।
আমরা জানি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকটি কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। তবে সব সদস্য রাষ্ট্রই আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন ও মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক রূপান্তর অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেয়। যেহেতু বৈঠকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাস করা হয়নি; তাই চীন বা রাশিয়া মিয়ানমারের জন্য কত দূর পর্যন্ত যেত, অর্থাৎ মিয়ানমারের পক্ষে তাদের ভেটো প্রয়োগ করত কি না, তা অজানাই রয়ে গেল। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আবারও নিরাপত্তা পরিষদের কোনো বৈঠক হলে তাতে কী সিদ্ধান্ত আসতে পারে বা আদৌ কোনো রেজল্যুশন নেওয়া হবে কি না বা তখন চীন ও রাশিয়ার অবস্থান কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল।
এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের কয়েক দিন পর অং সান সু চির দপ্তরের একজন মন্ত্রী ঢাকা সফরে আসেন। ২ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মিয়ানমারের মন্ত্রীর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত পোষণ করে। দুই দেশের মধ্যে এসংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি খসড়াও মিয়ানমারকে প্রদান করা হয়।
আমরা জানি নিরাপত্তা পরিষদে চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে। যদি চীনের পরামর্শে মিয়ানমারের মন্ত্রীর এ সফরটি ঘটে থাকে, তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর যদি মিয়ানমার সরকারের নিজস্ব অনুভূতি বা ভাবনা থেকে এ সফরটি ঘটে, তা হবে মিয়ানমারের গোঁয়ার্তুমি মনোভাব থেকে বের হয়ে আসার একটি ভালো উদ্যোগ। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই মনের ভেতর একটি প্রশ্ন জাগে। এই যে অং সান সু চির দপ্তরের একজন মন্ত্রী আলোচনার জন্য বাংলাদেশ এলেন, তাঁকে কি অং সান সু চি নিজের উদ্যোগে পাঠিয়েছেন? না কি পেছনে থাকা সামরিক শক্তির অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁকে পাঠানো হয়েছে? প্রথমটি হলে, ফলাফল কী হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ মিয়ানমার সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সু চির প্রভাব কতটুকু সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। আর দ্বিতীয়টি হয়ে থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে একটি সংশয় রয়েই যায়, কত দিনে সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হবে বা কিভাবে হবে?
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যত সহজে বলা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন ততটা সহজ হবে বলে কেন যেন মনে হয় না। এই মনে না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু আশঙ্কা কাজ করে। তাই ওই বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত, তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে দীর্ঘসূত্রতার গ্যাঁড়াকলে ফেলে সম্পূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটিকেই প্রলম্বিত করায় সচেষ্ট থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অবস্থানরত আগে আসা রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে শুধু গত বছরের অক্টোবর থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি বর্তমান কার্যক্রমে আনার বিষয়টি বলতে পারে। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দিয়ে বা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু ফিরে যাওয়ার পর তাদের আর নাগরিকত্ব দেবে না। ফলে পরে সহজেই তাদের আবার ভিটেমাটিছাড়া করা যাবে। চতুর্থত, ফিরিয়ে নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভিটায় জায়গা না দিয়ে ‘সেফ জোন’-এর নামে অন্যত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। এর পেছনে সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হতে পারে তাদের বংশানুক্রমে অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জায়গাজমি থেকে বঞ্চিত করা। অর্থাৎ এই কাজটি নাগরিকত্ব প্রমাণের বড় অস্ত্র ধ্বংস করার অতি সহজ উপায় হতে পারে। পঞ্চমত, এরই মধ্যে আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের সহিংস কর্মকাণ্ড যেমন হত্যা, ধর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করার জন্য সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক নেতা ও মানবতাবাদীরা এসব কর্মকাণ্ডকে রোহিঙ্গা নিধন বা গণহত্যার শামিল বলে আখ্যায়িত করছেন। ভবিষ্যতে এ নিয়ে মিয়ানমারকে যাতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় তা ভেবে আপাতত ফিরিয়ে নেওয়ায় রাজি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন শুরু করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা চালাতে পারে, আশ্রয় নিতে পারে ‘ধীর কূটনীতি’র।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একটি সন্দেহের কথা না বললেই নয়। এই যে মিয়ানমারের মন্ত্রী ঢাকা এসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে গেলেন, অথচ এখনো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়নি। রাখাইনে এখনো আগুন জ্বলছে, সহিংসতা একটুও থামেনি। এসব দেখে যে প্রশ্নটি জাগতেই পারে—মিয়ানমার কি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আসলেই আন্তরিক? না কি বিশ্বসমাজের চাপকে আপাতত থামাতে এ উদ্যোগ? কারণ, মিয়ানমারের পূর্ব ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। কিছু লোক ফেরত নিয়ে পুরো বিষয়টিকে ঝুলিয়ে দেওয়ার আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।
যাহোক, মিয়ানমারের মন্ত্রীকে দেওয়া চুক্তির খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া জানা যাবে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে পারে। এর পরই শুরু হতে পারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। তবে পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ নিতে, অর্থাৎ প্রত্যাবাসন শুরু হতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করে দুই দেশ বিশেষ করে মিয়ানমারের সততা, সদিচ্ছা আর আন্তরিকতার ওপর। এতে দুই মাস লাগতে পারে, আবার ১২ মাসও পার হয়ে যেতে পারে।
একটি বিষয়ে সবাই একমত হবে যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সামরিকভাবে নয়, কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে। তাই দ্বিপক্ষীয় ছাড়াও বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়তেই থাকে। যেহেতু এ সমস্যাটি বহু দিন থেকেই বারবার ঘটে আসছে, তাই ভবিষ্যতে যেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে লক্ষ রেখে এবার একটি স্থায়ী, নিরাপদ ও টেকসই সমাধানের জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা প্রস্তাব, আনান কমিশনের সুপারিশ ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গারা তাদের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটিতে মিয়ানমারের নাগরিক হয়ে নিরাপদে সম্মানের সঙ্গে যেন বসবাস করতে পারে, আসন্ন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি তা নিশ্চিত করবে, সে আশাই রইল।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
image-id-658532
মেয়েদের জীবন দুর্বিষহ করার অধিকার কারোর নেই
image-id-658516
অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
image-id-658513
মর্তে নরক ও নারী
image-id-657915
সু চির জন্য এলিজি এবং আমাদের ক্লেদাক্ত রাজনীতি