আবদুল বায়েস
খােলা বাজার২৪।।শনিবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০১৭:
রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি তবু নাম ছিল তার রুপা। স্বর্ণা, রুপা, আলো ইত্যাদি নাম রাখার পেছনে মা-বাবার সুপ্ত বাসনা ও যুক্তি থাকে, মেয়ে সোনা-রুপার গয়নার মতো উজ্জ্বল ও মূল্যবান হয়ে চারদিকে আলো ছড়াবে।
আমার নিবন্ধের নায়িকা রুপার মা-বাবার মনে হয়তো তেমন একটা কিছু ছিল। এবং তেমনটি বাস্তবায়নে রুপা যে বদ্ধপরিকর ছিল তার আলামত কম ছিল না। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, স্বপ্ন পূরণ করার আগেই তাকে মর্তের নরকের নরকভোগ করতে হলো—চলন্ত বাসে নরপশু তাকে ধর্ষণ করে ক্ষান্ত হয়নি, ঘাড় মটকিয়ে মেরে জঙ্গলে ফেলে দেয়।
বাবা আগে মরে বেঁচে গিয়েছিলেন, নয়তো মর্তের নরকে আদুরে মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে মরে যেতেন। মা এখন পাগলপ্রায়। বহুকষ্টে উচ্চশিক্ষা নিয়ে টানাটানির সংসারে হাল ধরতেই গার্মেন্ট কম্পানিতে রুপার চাকরি নেওয়া এবং আরো ভালো থাকার ও পরিবার ভালো রাখার জন্য পরীক্ষা দিতে বগুড়া যাওয়া। বোধ করি নতুন কাপড়চোপড়, সঙ্গে মাকে সুখবর দেওয়ার জন্য বগুড়া থেকে বাসে উঠেছিলেন। যেই ‘ছোঁয়া’ নামের বাসটিতে ড্রাইভারের সিটের সামনে সম্ভবত লেখা ছিল ‘আল্লাহর নামে চলিলাম’, সেখানে যে হিংস্র ছোবল ওত পেতে ছিল তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
যাই হোক, বাস চলল বটে, তবে নিরুপায় রুপার আহাজারি শোনার কেউ ছিল না।
বাসের ভেতর একের পর এক ধর্ষণ করা ও ঘাড় মটকে মেরে ফেলা যেন গায়ে কাঁটা দেওয়া লোমহর্ষক গল্প, যা ভূতুড়ে সিনেমায় দেখি। লক্ষণীয় যে রুপার ধর্ষণ ও মৃত্যুর পর সমাজ যতটুকু প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত ঠিক ততটুকু দেখায়নি। অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর বলে বোধ হলে এমনটি হয়; অথবা বলা যায় সবই এখন যেন গা সওয়া গোছের হয়ে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে বর্তমান বাংলাদেশে ধর্ষণের বা নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। তবে তা রিপোর্ট বাড়ার জন্য, না আসলেই সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সেটা গবেষণার বিষয়। প্রথমটি হলে সুখবর এই অর্থে যে অন্তত নালিশ করার জায়গাটুকু মিলেছে।
দুই.
ঐতিহ্যগতভাবে যেকোনো ধর্ষণের ঘটনার পরপরই জাতি কিছুটা হলেও জেগে উঠে ধিক্কার, চেঁচামেচি, হৈচৈ বাধিয়ে অন্তত পুলিশকে বাধ্য করে আড়মোড়া ভেঙে অপরাধী খুঁজতে; গণতান্ত্রিক একটা সমাজে সরকারের টনক নড়ে। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ধর্ষণ হচ্ছে টিপ অব দ্য আইসবার্গ, বরফের ওপরের দৃশ্যমান দিক মাত্র। হররোজ নারীকে নীরবে-নিভৃতে নির্যাতন করা হচ্ছে অন্দরে, অলিতে-গলিতে অশ্রাব্য গালিতে, আকার-ইঙ্গিতে। আবার সমবেদনার নামে শব্দচয়নও ওই দিকে কম যায় না—‘মাগি মুখের ওপর কথা কস, তোর সাহস দেহি কম না, যেদিন বাইন তালাক দিয়া দিমু বুজবি মজাডা’; দুইজনে গরম অইলে চলে না আপা, আপনি একটু ঠাণ্ডা থাইকেন; বুঝেন তো ‘মরদ কা বাত হাতি কা দাঁত। ’ আর যারা লেফাফাদুরস্ত তারা বলবে, ‘শোনেন আপা, আমি আপনি ফ্রেন্ড হইতে অসুবিধা কী—এ ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ এ ফ্রেন্ড ইন ডিড …। ’
আমেরিকার মতো দেশে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ধর্ষণের শিকার বহু সেলিব্রিটি। মোট কথা, এই খেলায় ধনী-গরিব, ধর্মগুরু-শিস্য, শিক্ষক-ছাত্রী, নেতা-নেত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ফারাক নেই। ধর্ষণ ও নির্যাতন ফিটস অল। ফারাক এক জায়গায়—ধর্ষিতা শুধু নারী নামে এক শ্রেণি (এবং শিশু)।
তিন.
ব্র্যাকের জেন্ডার ও জাস্টিস বিভাগ নারী ও শিশুদের নির্যাতন বা হয়রানি রোধে নেওয়া নানা রকম পরিকল্পনায় মতামত জানাতে আমাকেও আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে শুনি, অন্তত ব্র্যাক পরিবৃত পরিসরে নির্যাতনের সংখ্যা ২০১৫ সালের পাঁচ হাজার থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত সাত হাজার অর্থাৎ প্রতি জেলায় প্রতি মাসে গড়ে ১৭টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর ভেতর দৈহিক নির্যাতন মোট নির্যাতনের ৬০ শতাংশ, যা আগের চেয়ে বেশি। ধর্ষণ, দলগত ধর্ষণ ও ধর্ষণের সুযোগ মোট হয়রানির ১০ শতাংশ। ধর্ষণের ঘটনা কমছে তবে দলগত ধর্ষণ বাড়ছে বলে মনে হয়। দেখা গেছে, অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাব পায় আর ভুক্তভোগীর বেশির ভাগ ঘঙে সম্পৃক্ত নয়। যাই হোক, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে ৯০০ প্রচেষ্টা নিয়েছে হয়রানি বন্ধের জন্য।
সিনিয়র ডিরেক্টর আসিফ সালেহ একটি ভিডিওর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন; রুপা মেয়েটির ধর্ষণ ও মৃত্যুর পর শুধু বিভিন্ন শ্রেণির পুরুষের প্রতিক্রিয়া এতে তুলে ধরা হয়। ব্যাপারটা ব্যতিক্রম বটে, কারণ নারী ও শিশু নির্যাতনে নারীদের নড়াচড়া পুরুষের তুলনায় ঢের বেশি থাকে। ভিডিওটি ফেসবুকে কয়েক লাখ লাইক পেয়েছে বলে শুনেছি। যাই হোক, দেখে মনে হলো, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব শেয়ালের এক রা, দিনকাল বহুত খারাপ; মেয়েদের বুঝেশুনে পোশাক পরা ও হাঁটাচলা করা উচিত।
আমরা সবাই নারী নির্যাতনজনিত পরিস্থিতির প্রান্তিক নয় বস্তুত ব্যাপক উন্নতি চাই। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব? নির্যাতন তো নানা রকম, তাই নিরাময়-পথ্য নিরাবরণ নয়, অর্থাৎ কোনো ম্যাজিক বুলেট আছে বলে মনে হলো না। একসময় আলোচনা গড়ায় মূলত ধর্ষণকে ঘিরে এবং এটিই স্বাভাবিক যেখানে ইদানীং যোগ হয়েছে গ্যাংরেপ।
দেশের বর্তমান আইন কাঠামো, ধর্ষিতা ও ধর্ষক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণ বন্ধ হবে এমন আশা বাতুলতা মাত্র। বস্তুত যে লাউ সেই কদু। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ধর্ষকদের বেশির ভাগ ধনশালী, প্রভাবশালী ও শ্রেণিভুক্ত। যেমন শিক্ষক আসামি হলে সমিতি তাঁর পক্ষে দাঁড়ায়; তেমনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-মোক্তার। আইনের ফাঁকফোকরে ধর্ষক বেরিয়ে এসে বুক চিতিয়ে সেই আপ্তবাক্য প্রমাণ করার চেষ্টা চালায়—‘বিচার প্রলম্বিত মানে বিচার বঞ্চিত’ (justice delayed, justice denied)। আদালতে অভিযোগ এলেই ধর্ষিতাকে প্রথম প্রশ্ন, আপনি ধর্ষণের মুহূর্তটিতে কী পোশাকে ছিলেন; কখন বাইরে গেলেন? এই শহরে একা যাওয়াটা কি নিরাপদ ছিল—ইত্যাদি প্ররোচনা ও প্রহসনমূলক প্রশ্ন করে পুরো ভারী একটা বিষয় লঘু করার গুরু প্রচেষ্টা। কেউ আবার পানের সঙ্গে জর্দা মিশিয়ে ‘মসলামিশ্রিত’ প্রশ্ন ছুড়ে দেয়—আপনার সঙ্গে তো আসামির ফষ্টিনষ্টি ছিল, তাই না? আর সেই চর্বিতচর্বণ চিরায়ত জিজ্ঞাসা তো চলছেই এবং হয়তো চলবেও যত দিন ধর্ষক বেঁচে থাকবে, কেউ কি দেখেছে যে আমার মক্কেল ধর্ষণ তো দূরে থাক তোমাকে আলতো হাতে ধরেছে? কী জন্য মানির মান নষ্ট করতে আসছ? পাঠক, দয়া করে হতাশ হবেন না, কারণ পরিস্থিতি এমনকি ভারতসহ অন্যান্য দেশেও এমনটি আছে। বাংলাদেশে একটু বেশি মাত্রায় এই যা।
সুতরাং বলা বোধ করি নিষ্প্রয়োজন যে প্রয়োজন এখন বিশেষ আইন, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবী ও আলাদা আদালতের। দুই. স্কুল থেকে পাঠ্যক্রমে যৌনবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি। তিন. সমাজ থেকে ধর্ষণ-নির্যাতন বন্ধ করতে বা কমাতে হলে পুরুষকে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যেতে হবে। সিনেমা, নাটক, গান, খেলাধুলা প্রতিটি স্তরে নীরবে অথচ নিখুঁতভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরোধী বক্তব্য দেওয়া যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। চার. সমাজে সব পেশাজীবীর পক্ষ থেকে নির্যাতন তথা ধর্ষণবিরোধী বলিষ্ঠ বক্তব্য থাকতে হবে। তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড়, কবি, সাহিত্যিক শুধু মঞ্চ, পর্দা আর মাঠে থাকলে হবে না, নারী নির্যাতনের ভয়াবহতাকে বিবেচনায় নিয়ে যথাসম্ভব বাস্তব পদক্ষেপ নিতে কসুর করবেন না। পাঁচ. রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি চাই, যেখানে দলমত-নির্বিশেষে সবাই ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেবে না। এবং সবশেষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতার খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে। রুপা আর তনুর মতো মেয়ে প্রতিটি ঘরে আছে কিন্তু ঘরে বা বাইরে কেউ যে নিরাপদ নয় সে কথা যেন আমরা কখনো ঘুণাক্ষরেও ভুলে না যাই, যা কি না ভারতের একটি মেয়ের ভাষায়—‘কহি নাহি সুরক্ষিত হাম সব, চাহে বাজার হ ইয়া ঘার। ’
মায়ের সঙ্গে ফোনে রুপার শেষ কথা—‘আমি এখন বাসে আছি, বাসায় পৌঁছে তোমাকে জানাব। ’ ভাবি, আমার মেয়েরাও মাঝে মাঝে ওই কথা বলে মাকে প্রবোধ দেয়; বুকটা আমার ধড়ফড় করে প্রশ্ন তোলে, ওরা কি নিরাপদ? ভারতের একজন স্কুলছাত্রীর খোলা চিঠি—Let me live without fear of being raped or abused. হোক না ওটাই খোলা চিঠি আমার দেশের মেয়েদের, এমনকি আমাদের সবার।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়