Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

তসলিমা নাসরিন
খােলা বাজার২৪।।রবিবার, ১৫ই অক্টোবর, ২০১৭: ভারতের দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ফতোয়া জারি করা জায়েজ। এই মাদ্রাসা দু’দিন হলো ফতোয়া জারি করেছে, মেয়েদের চুল কাটা, ভ্রূ প্লাগ করা ইসলামে নিষিদ্ধ, সুতরাং মুসলিম মেয়েরা না পারবে চুল কাটতে, না পারবে ভ্রূতে হাত লাগাতে।

মাওলানা সাদেক কাশমি বলেছেন, মেয়েদের বিউটি পারলারে যাওয়াও নিষেধ। ২০১০ সালে মেয়েদের চাকরি করে টাকা রোজগার করার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছিল। মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরোবে, অফিসে যাবে, নারী পুরুষ এক অফিসে বসে কাজ করবে, এটা নাকি ইসলাম মানে না। মৌলানাদের কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে মেয়েদের চুল, চোখ, বুক, পেট, পা, পায়ের পাতা নিয়ে পড়েছে? কী পরবে মেয়েরা, কী পরবে না, কী করবে, কী করবে না— এ নিয়ে গবেষণা সেই যে চলছিল, এখনও চলছে। মেয়েদের শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই মৌলানাদের। এই একবিংশ শতাব্দীতে ঘোষণা দিচ্ছে মেয়েদের চুল কাটা হারাম, ভ্রূ প্লাগ করা হারাম, পারলারে যাওয়া হারাম! এরা মেয়েদের দেখতে চায় ঘর সংসার করছে, সন্তান বড় করছে, স্বামীকে সুখ দিচ্ছে এবং স্বামীর আদেশ-নিষেধ মুখ বুজে পালন করছে। এ ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা মৌলানাদের কেউ স্বীকার করে বলে মনে হয় না। প্রায়ই শুনি ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম মেয়েদের প্রচুর মর্যাদা দিয়েছে।

এই বাণীগুলোর সঙ্গে তো ফতোয়ার মিল থাকতে হবে। মেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া চলবে না, চাকরি-বাকরি করা চলবে না, ব্যবসা-বাণিজ্য করা চলবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করা চলবে না, বাড়ির বাইরে বেরোনো চলবে না, স্বাধীন মতামত দেওয়া চলবে না, স্বাধীন চলাফেরা চলবে না, প্রেম করা চলবে না, নিজের পছন্দমতো বিয়ে করা চলবে না, পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা চলবে না, হিজাব বোরখা ছাড়া রাস্তায় পা রাখা চলবে না, স্বামীর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন না করা চলবে না, সন্তান লালন-পালনে কোনও ত্রুটি থাকা চলবে না। জোরে হাসা, জোরে কথা বলা চলবে না। চলবে না’র কোনও শেষ নেই। মেয়েদের কি এভাবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়? যাকে পুরুষের কন্যা, পুরুষের স্ত্রী, পুরুষের মা, পুরুষের বোন ছাড়া আর কোনও পরিচয় দেওয়া হয় না, তাকে আসলে কোনও মর্যাদাই দেওয়া হয় না। পুরুষতান্ত্রিক ধর্মে এবং সমাজে নারীর একটিই পরিচয়, সে দাসী। ক্রীতদাসী, সেবাদাসী, যৌনদাসী। এসব পরিচয়ের বাইরে অন্য কোনও পরিচয়ে ফতোয়াবাজেরা মেয়েদের দেখতে চান না।

মেয়েরা তাদের মাথার চুল নিয়ে, ভ্রূ নিয়ে কী করবে, তা মেয়েদেরই বুঝতে দেওয়া উচিত। পুরুষেরা তাদের শরীর নিয়ে কী করবে, শরীরের কোথাকার চুল কী মাপে রাখবে, শরীরের কোন অংশ কতটুকু ঢাকবে, এইসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে, আমি শুনিনি, মেয়েরা জ্ঞান দিচ্ছে। পুরুষ তার নিজের পছন্দ মতো নিজে চলে, সে চলুক, কেউ বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু মুশকিল হলো, পুরুষেরা নিজের পছন্দ মতো মেয়েদেরও চলতে বাধ্য করে। মেয়েদের পৃথক অস্তিত্ব তারা আজও স্বীকার করে না। এককালে অন্ধকার যুগে না হয় স্বীকার করতো না, কিন্তু এখন তো দিন দিন সভ্য হওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে, এই চেষ্টার সময়টায় মেয়েদের যদি নিজের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বাঁচতে দেওয়া না হয়, তবে সভ্যতা চিরকালই ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাবে। এ নিশ্চিত।

ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা না করলে যেমন রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। সমাজ থেকে ধর্মকে আলাদা না করলে সমানাধিকারের ভিত্তিতে একটি সুস্থ এবং সভ্য সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সভ্য জগৎ গড়ে তুলতে হলে এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সরিয়ে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সীমানায় আমাদের আজ না হোক কাল আনতেই হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এককালে রাজ্য শাসন করতো, তখন ধর্মের নামে এত অরাজকতা করা হতো, মানবাধিকারকে এত লঙ্ঘন করা হতো, নারীকে এত নির্যাতন করা হতো যে রাজ্য শাসনের ভার ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে।

নারীর অধিকারকে সম্মান করতে হলে, বাকস্বাধীনতাকে মানতে হলে, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সরকারি এবং বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে হতে হবে মৌলবাদ-মুক্ত। দেওবন্দে ধর্ম চর্চা হচ্ছে হোক, কিন্তু মৌলবাদের চর্চা হলে মুশকিল। ওটি হলেই ফতোয়া জারি শুরু হয়। গণতন্ত্রে ফতোয়ার কোনও ঠাঁই নেই। মুসলিম মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরানো হলে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের কী হবে? ভারতবর্ষে অমুসলিম মেয়েরাই শুধু উপভোগ করবে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, মুসলিম মেয়েরা নয়? সবচেয়ে দুঃখের সংবাদ এই যে, অমুসলিমরা নয়, মুসলিম পুরুষরাই মুসলিম মেয়েদের ন্যূনতম অধিকার, ন্যূনতম স্বাধীনতা পাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি কতটা সভ্য, তা কিন্তু তোমার সমাজে মেয়েরা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে তার ওপর নির্ভর করে।

মুসলিমরাই যখন মুসলিমদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তখন মুসলিম সমাজটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। মেয়েদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা, প্রগতিশীল লেখকদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা, ধর্মের নামে অমুসলিমদের ঘৃণা করা, মুক্তচিন্তকদের হত্যা করা— চলছেই। অনেকে বলে, আর কারও নয়, মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েরই নাকি শুধু আছে ফতোয়া দেওয়ার অধিকার। ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক বছর আগে একটি ফতোয়া ঘোষিত হয়েছিল, ‘পুরুষের সঙ্গে এক অফিসে বসে কাজ করা মেয়েদের জন্য অনৈসলামিক। এই অনৈসলামিক ব্যাপারটিকে বৈধ এবং ইসলামিক করতে হলে মেয়েদের যা করতে হবে তা হলো সহকর্মী-পুরুষদের নিজেদের স্তন্যপান করাতে হবে। ’ স্তন্যপান করালে সহকর্মী পুরুষেরা মেয়েদের সন্তান-সম হয়ে উঠবে। সন্তানের সামনে যেহেতু কোনও বাধা নেই যেতে, তাই মেয়েদেরও কোনও ধর্মীয় বাধা থাকবে না ওই পুরুষগুলোর সামনে যেতে, তাদের সঙ্গে এক অফিসে বসে কাজ করতে। এইসব অস্বস্তিকর, অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক, অদ্ভুত, অসভ্য, অমানবিক ফতোয়া দেখে মানুষ হাসে, বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়। এককালে মুসলিমরা বিজ্ঞানী ছিল, এককালে মুসলিমরা এই আবিষ্কার করেছে, ওই পাড়ি দিয়েছে বললে সাতখুন মাফ হয়ে যায় না। এখন কী করছো, এখন আদৌ বিজ্ঞানমনস্ক কি না সে কথা বলো, এখন কী আবিষ্কার করছো, কী পাড়ি দিচ্ছো, সেটা বলো। মেয়েদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা বন্ধ করেছো? মেয়েদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছো? মেয়েদের শরীর থেকে তোমার চোখ রাঙানি আর হস্তক্ষেপ সরিয়ে নিয়েছো? সভ্য হতে গেলে এগুলো করতে হয় প্রথমেই। তা না হলে সভ্যতার প্রথম পদক্ষেপই রচনা করা সম্ভব হয় না।

মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া বন্ধ হোক। উপদেশে কাজ না হলে আইন করে ফতোয়া বন্ধ করা হোক। দেশে সভ্য আইন আছে, ফতোয়ার প্রয়োজন নেই। মেয়েদের জীবনকে দুর্বিষহ করার অধিকার কারোর নেই। গণতন্ত্র সবার জন্য। নারী পুরুষ হিন্দু মুসলিম ছোট বড় সবাই যে দেশে একই রকম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে না, সে দেশের গণতন্ত্র আদৌ গণতন্ত্র কি না এ নিয়ে সংশয় জাগে।