খােলা বাজার২৪।শুক্রবার, ২০শে অক্টোবর ২০১৭: মিয়ানমারের ওপর, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর বিধি-নিষেধ জারির বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়েই ভাবছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালানোর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তারা এই বিধি-নিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত সামরিক অভিযানের কারণে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ইইউ তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে, ন্যূনতম মাত্রায় হলেও বিধি-নিষেধ জারির সিদ্ধান্ত নেবে। প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত প্রস্তাব সে কথাই বলছে। তবে বড় ধরনের বিধি-নিষেধের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে তারা বিরত থাকবে। পরে পরিস্থিতি বিবেচনা করে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেবে তা এখনো নির্দিষ্ট নয়, যদিও কূটনৈতিক পরিসরে বিধি-নিষেধের বিষয়ে আলোচনা বেশ ভালোভাবেই চলছে।
ওয়াশিংটন, ইয়াঙ্গুন ও ইউরোপের ডজনেরও বেশি কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বোঝা গেছে তা হলো, এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আপাতত শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের কথা ভেবেই নেওয়া হচ্ছে। তাদের ভাবনায় অনেক বিকল্প রয়েছে। এখনো সব নির্দিষ্ট করা না হলেও জেনারেলদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে অপেক্ষা করবে। সহিংসতাকবলিত রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়েও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই আহ্বান জানাবে।
অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সক্রিয় আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট, মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহারে দেশত্যাগ পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৎপর হতে বাধ্য করছে। এক মাস আগেও বিধি-নিষেধের বিষয়টি আলোচনার তালিকায় ছিল না। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে সারা বিশ্বেই আলোচনা চলছে। বহির্বিশ্বে যে শোরগোল দেখা যাচ্ছে, এর বেশির ভাগ নোবেল বিজয়ী ও মিয়ানমারের জাতীয় নেত্রী অং সান সু চিকে নিয়ে। কোনো কোনো পশ্চিমা কূটনীতিক তাঁর নেতৃত্বের বিকল্প দেখতে চান। কারণ তিনি সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সেনা প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী এখনো সেনাবাহিনী প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী। বাস্তবে সু চি ক্ষমতাসীন হলেও কার্যকর কোনো ক্ষমতা তাঁর আছে বলে মনে হয় না।
ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নির্ধারিত বৈঠকে কঠোর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে, এ আশা কূটনৈতিক অঙ্গনের কর্মকর্তারা করছেন না। বাস্তবেও তেমনই হওয়ার কথা। ডেনমার্কের উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী উলা চারনেসের কথা থেকে যা বোঝা যায় তা হলো, কোপেনহ্যাগেন মিয়ানমারের সংকটের বিষয়টিকে এজেন্ডাভুক্ত করবে দেশটির সামরিক বাহিনীর ওপর আরো চাপ তৈরির জন্য। আর ট্রাম্প প্রশাসনের মিয়ানমারসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবহিত ওয়াশিংটনের দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের কমান্ডার-ইন-চিফ মিন অং হ্লাইং ও আরো কিছু জেনারেল এবং রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ মিলিশিয়া নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়গুলো হোয়াইট হাউসের বিবেচনায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র উল্লিখিত ব্যক্তিদের বিদেশে গচ্ছিত সম্পত্তি জব্দ করা ও তাঁদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, মিয়ানমারে মার্কিন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা প্রভৃতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এসব ব্যাপারে ওয়াশিংটন সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন সরকার এবং জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে তারা।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক জানিয়েছেন, চলমান সংকটের নিরিখে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের তৎপরতার সমন্বয় করছে। তারা একটি ব্যাপারে এক মত যে সেনাবাহিনী, নির্দিষ্ট করে কমান্ডার-ইন-চিফ হবেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার লক্ষ্য। প্রতীকী ব্যবস্থাই আপাতত নেওয়া হবে। আরো আলোচনার সুযোগ রাখার জন্যই তা করা হবে। আপাতত কমান্ডার-ইন-চিফের (ও আরো কিছু জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা) ইউরোপ সফরে নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। গত বছর তিনি ব্রাসেলস, বার্লিন ও ভিয়েনা সফর করেছেন। আর যাতে সফরে যেতে না পারেন সে ব্যবস্থাই করা হবে।
পশ্চিমা কূটনীতিকদের ভাষ্য অনুযায়ী চীনের তুলনায় ইইউর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিসর সীমিত। সু চির ক্ষমতাগ্রহণের ১৮ মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উষ্ণতর হয়েছে। এ ছাড়া দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর বিনিয়োগ ও সামরিক সম্পর্ক কম। তাদের মধ্যে একটা ভয়ও রয়েছে, কঠোর ব্যবস্থা নিলে মিয়ানমারের সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে বা সু চির সঙ্গে সেনাবাহিনীর টানাপড়েন আরো বেড়ে যেতে পারে। ফলে মিয়ানমার অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। রাখাইনের অন্যান্য অঞ্চলে ত্রাণ তৎপরতা বাড়ানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে জাতিসংঘ। ওই সব এলাকায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। ত্রাণ তৎপরতা বাড়ানো, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত ও পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া—এসব ব্যাপারে মিয়ানমার কিভাবে সাড়া দেয় তার ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সিদ্ধান্ত। ইইউ রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে, মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে। সেখানে তাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম রয়েছে, উন্নয়ন সহায়তামূলক কার্যক্রম রয়েছে। মিয়ানমারে যদি যথাযথ পরিস্থিতি না থাকে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকে তাহলে ইউরোপীয় কমিশন (ইসি) সেখানে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করবে না। অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও রয়েছে। মিয়ানমারে সংস্কার চলছে, তাই তাদের ভেবে দেখতে হচ্ছে, দেশটিকে সহায়তা করা হবে, পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণের দিকে নজর দেওয়া হবে নাকি কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১২ সালে সরাসরি সরকার পরিচালনা থেকে সেনাবাহিনীর সরে দাঁড়ানোর পর মিয়ানমারের ওপর থেকে ইইউর অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়া হয়েছিল। দেশটিতে গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এর ফলেই গত বছর ক্ষমতায় আসেন সু চি। তবে ১৯৯০ সালের দিকে জারি করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে। যুক্তরাষ্ট্রও গত হেমন্তে অবরোধের বেশির ভাগ তুলে নিয়েছে। তবে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তারা এখনো জারি রেখেছে।
ওয়াশিংটন মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ডেডলাইন আরোপ করেনি। তবে মিয়ানমারের ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নভেম্বরের প্রথমার্ধের মধ্যে এশিয়া সফরে বের হবেন তিনি; বেশ কিছু শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন। ওই সময়ের মধ্যেই তিনি ওই পরিকল্পনা চান। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে কড়া বার্তা দিতে চায়। এটাও তারা ভাবছে, খুব তাড়াহুড়া করে ব্যবস্থা নিলে চীন দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ পাবে। বড় ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতর থেকে সমর্থন কমই পাবেন। সত্যিই কী ভাবনা চলছে সে ব্যাপারে কথা বলতে রাজি নয় হোয়াইট হাউস।
মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরির জন্য আরো যে তৎপরতা চলছে, সেসব বিষয়ে নিউ ইয়র্কভিত্তিক কূটনীতিকদের বক্তব্য হলো, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মানবাধিকারবিষয়ক প্রস্তাবের জন্য চাপ দিচ্ছিল ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। গত বছর ইইউ বলেছিল, তারা সাধারণ অধিবেশনের তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে কোনো প্রস্তাব তুলবে না। এবার তারা ওআইসির খসড়া ধরে প্রস্তাব করতে পারে। তবে খসড়া প্রস্তাবের আওতা বাড়াতে চায় তারা। শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সীমাবদ্ধ না থেকে আরো বিষয় জুড়তে চায় তারা। নিরাপত্তা পরিষদের কিছু সদস্য ভেবে দেখছে, ১৫ সদস্যের এই সংস্থা আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দিতে রাজি হয় কি না। অথবা কোনো প্রস্তাব পাস করা যায় কি না, যাতে মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ করা, ত্রাণ তৎপরতার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া ও রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আহ্বান থাকবে। অন্যদিকে মিয়ানমারও চেষ্টা করছে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে দেনদরবার করছে তারা। নিরাপত্তা পরিষদে এ দুই দেশের ভেটো পাওয়ার আছে। মিয়ানমার এ চেষ্টা করছে যাতে সম্ভাব্য ব্যবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। চীন ও রাশিয়া উভয়েরই মিয়ানমার সরকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্ক বিরোধাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত জুলাইয়ে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের একটি ক্যাম্পে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার বিস্কুট পাওয়ার পর এ সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়েছে। মিয়ানমার সরকার অভিযোগ করেছে, জাতিসংঘ বিদ্রোহীদের মদদ জোগাচ্ছে। রাখাইনে জাতিসংঘের ওই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের কান্ট্রি হেডকে প্রভাবশালী র্যাংক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেলের (এএসজি) মর্যাদায় উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে জাতিসংঘ। পরবর্তী কান্ট্রি হেডের সময় থেকেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় তারা। কিন্তু মিয়ানমার এতে বাদ সাধছে। সু চির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং তুন বলেছেন, জাতিসংঘ সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখবে। এএসজি মর্যাদার কাউকে বরণ করতে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সব দেশেই এ মর্যাদার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে হবে, শুধু তাদের ক্ষেত্রে নয়।
লেখক : দুজনই রয়টার্সের সঙ্গে যুক্ত
সূত্র : রয়টার্স
ভাষান্তর : সাইফুর রহমান তারিক
সম্পাদকীয় টীকা : গত সোমবার (১৬ অক্টোবর) লুক্সেমবার্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নির্ধারিত বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত খসড়া প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ইইউ ও সদস্য দেশগুলো মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে কমান্ডার-ইন-চিফকে ইউরোপে আমন্ত্রণ জানাবে না। আগে কোনো শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকলে সেটি স্থগিত হবে। এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাসের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর ধরা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক যে সমঝোতা রয়েছে, তা সামগ্রিকভাবে ইইউ ও আলাদাভাবে সদস্য দেশগুলো পর্যালোচনা করবে। পরিস্থিতি মোতাবেক পরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ইইউর পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এসবের বাইরে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না সে ব্যাপারে সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।