Tue. May 6th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)
খােলা বাজার২৪। বুধবার, ২৫ অক্টোবর ২০১৭: ১৬ অক্টোবর সোমবার কালের কণ্ঠ’র প্রথম পাতায় অন্যতম একটি হেডিং ছিল—‘জিয়ার হাতেই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ’ ১৫ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সময় এ কথাটি বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা।
সংগত কারণেই খবরটি বিশাল এক বোম্বশেল হিসেবে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অন্তত ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছি। তাঁরা সবাই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সুর ছিল সবার প্রায় একই রকম। তাঁরা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, কে এম নুরুল হুদা কী প্রকৃতই একজন মুক্তিযোদ্ধা, নাকি কাগুজে বাঘ। এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। কারণ আমার সেটা জানা নেই।

মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, একাত্তরে যাঁরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের তো কোনো কিছুতে ভয় পাওয়ার কথা নয়, এমনকি মৃত্যুকেও না। তাঁরা তো মৃত্যুর ঘর থেকেই ফিরে এসেছেন।
আমি নিজেও ভয়ানক বিভ্রান্তিতে পড়েছি। কে এম নুরুল হুদা যা বলেছেন সেটি আমরা নতুন শুনছি তা নয়। এই কথা এত দিন আমরা শুনে আসছি জামায়াত, বিএনপি, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের পরাজিত গোষ্ঠীর কাছ থেকে, যারা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ বলতে যেমনটি বোঝায় সেটিকে এখনো মেনে নিতে পারেনি। এরা পঁচাত্তরের পর থেকে গত ৪২ বছর মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ প্রপাগান্ডা চালিয়ে আসছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। সেই অপচেষ্টায় তারা সফল হয়নি। কিন্তু ক্ষান্তও দেয়নি। তাহলে কি এখন ধরে নিতে হবে মুক্তিযোদ্ধা সিইসি কে এম নুরুল হুদা সেই প্রপাগান্ডায় যোগ দিলেন। তিনি এখন শুধু একজন ব্যক্তি নুরুল হুদা নন। সিইসি হিসেবে তিনি যা বলবেন, সত্য-মিথ্যা সেটাই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের রেফারেন্স হবে। পদের ওজন বহন করার সক্ষমতা রয়েছে বলেই তিনি এই পদে নিয়োগ পেয়েছেন। যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বহুদলীয় গণতন্ত্র যদি জিয়াউর রহমান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে থাকেন, তাহলে কেউ না কেউ তাঁর আগে সেটিকে ধ্বংস বা হত্যা করেছে। সিইসি তাহলে কি বলতে চান?

সিইসির এমন অবিবেচনাপ্রসূত, অসত্য ও দূরদৃষ্টিহীন কথা বলার কারণে আজ আবার কিছুটা পুরনো কাসুন্দি আওড়াতে হবে। দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করি। এক. জিয়াউর রহমান একই সঙ্গে সেনাবাহিনীপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি। এক হাতে অসীম ক্ষমতা। ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতির বিনিময়ে অর্জিত বাহাত্তরের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও আদর্শের প্রতিফলনসংবলিত সব শব্দ, বাক্য ও অনুচ্ছেদ জিয়াউর রহমান তাঁর অসীম ক্ষমতাবলে একের পর এক সামরিক ফরমান জারি করে বাতিল করে দেন। এই কথার অকাট্য দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে পঞ্চম সংশোধনীর পর প্রিন্টেড কপি মিলিয়ে দেখলে যে কেউ এটা সহজে বুঝতে পারবেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, দাবি ও অধিকার তিনি বন্দুকের ভয় দেখিয়ে এক হুকুমেই সব নেই করে দিলেন। এটাই কি তাহলে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নমুনা? এর মাধ্যমে কি গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো, নাকি বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে সেটি কেড়ে নেওয়া হলো? তিনি তো গণমানুষের ম্যান্ডেটের জন্য অপেক্ষা করলেন না। কিসের এত তাড়া! রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শূন্য জিয়াউর রহমানকে কারা পেছন থেকে ওই সব করার জন্য বুদ্ধি ও তাড়া দিচ্ছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানের দোসর, গণহত্যার সহযোগী শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলিম, মাওলানা মান্নান গং, এরা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী হয়ে তখন জিয়ার চারপাশে ছিলেন।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের এক লড়াই শেষ হতেই আমাদের আবার স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করার যে কারণ তার এক নম্বরে ছিল আমরা পরিপূর্ণ ও ত্রুটিহীন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি, যার দার্শনিক শক্তির উৎস হিসেবেই বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ হিসেবে সন্নিবেশিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। জিয়াউর রহমান কলমের এক খোঁচায় তা বাতিল করে দিলেন। স্বৈরশাসক ও একনায়ক শাসকরাও যুগে যুগে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে আসছেন। দেশের নাম গণপ্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া (উত্তর কোরিয়া)। কিন্তু গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। নামের সঙ্গে কাজের সব কিছুতে অমিল। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্বে অনুসৃত উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই এখন গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক উদাহরণটিই বেশি উজ্জ্বল। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে পূর্ণ গণতন্ত্র থাকে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হ্যারি এ ব্ল্যাকমুন ১৯৯২ সালে সাংবিধানিক ব্যাখ্যার এক রায়ে উল্লেখ করেন—’Allowing religious differences to invade the public arena presented a direct threat to the fundamental concepts of freedom, equality and democracy.’ সুতরাং সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রকে জগাখিচুড়ি বানিয়েছিলেন, যে জঞ্জাল এখনো পরিপূর্ণভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। যদি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল থাকত, তাহলে গণতন্ত্রের বড় শত্রু ধর্মীয় উগ্রবাদে বিশ্বাসী জঙ্গি সন্ত্রাসীদের উত্থান বাংলাদেশে হতে পারত না।

দুই. জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য আছে। তবে স্বঘোষিত খুনিদের আইনের আওতায় আনার সব ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের জিয়াউর রহমান কর্তৃক দূতাবাসে চাকরি দেওয়া ছিল গণতন্ত্রের অন্যতম নিদর্শন আইনের শাসনের জলাঞ্জলি।

তিন. সামরিক পোশাক পরে, সেনাবাহিনীর প্রধান পদে বহাল থেকে প্রহসনের নির্বাচনে ভোটাররা কেন্দ্রে যাক আর না যাক, হ্যাঁ-না গণভোট করে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে নিজের বৈধতা অর্জনের চেষ্টা করেন। ১৯৭৮ সালে নিজে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেন সেনাবাহিনীর পদে বহাল থেকে। তাতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটির বর্ণনা দিতে গেলে কয়েকটি কলামের জায়গায়ও কুলাবে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমের আত্মকথা পড়লে বোঝা যায় জিয়াউর রহমান কত বড় (!) গণতান্ত্রিক শাসক ছিলেন। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের হাত ধরে জামায়াত, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্য কিছু হয়নি।

এত সময় যা উল্লেখ করলাম সেগুলোর সবই পুরনো কথা। সবাই জানেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও জানেন। তাঁর নিয়োগের সময় প্রবল বিরোধিতা করেছে বিএনপি এবং শিষ্টাচারবহির্ভূত কথাবার্তাও বলেছে। কে এম নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, এমন হুমকিও দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিএনপি সংলাপে গেল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদ। জিয়াউর রহমানের তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের আসল স্বরূপ জানা থাকা সত্ত্বেও আজকের রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় সিইসি সেগুলো বলবেন না এবং আমি মনে করি সেটি তাঁর বলাও উচিত নয়। কিন্তু যা নয় সেটি আগ বাড়িয়ে তিনি বলতে গেলেন কেন? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চারদিকে শুধু গুজব আর গুজব। তাই কার মনে কী আছে তা মানুষকে ভাবনায় ফেলে। অনেকে বলছেন, সিইসি শপথ ভঙ্গ করেছেন। ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে, অনুরাগ, বিরাগের বশবর্তী না হয়ে তিনি দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়াউর রহমানকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও তাঁর সব কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা এবং সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে বাতিল করে দিয়েছেন। আদালতের কথার থেকে সিইসির কথা তো উল্টো হয়ে গেল।

অনেকে অনেক কথা বলবে, দাবিদাওয়া তুলবে, রাজনৈতিক হুমকি-ধমকি দেবে। বাংলাদেশের জন্য এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। এগুলো জেনেশুনেই তো তিনি এ পদের ভার স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়েছেন। কিন্তু সংবিধান ও আইনই হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের রক্ষাকবচ ও বাইবেল। এর মধ্যে তাদের সীমানা। অনেক পক্ষ ও গোষ্ঠী আছে, যারা নানা কৌশলে নির্বাচন কমিশনকে সীমানার বাইরে আনার অসৎ চেষ্টা করবে। একবার সফল হলেই বলতে পারবে, এরা সংবিধান লঙ্ঘন করেছে বিধায় এদের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সুতরাং কারো পাতা ফাঁদে পা যাতে না পড়ে তার জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অন্য সব পূর্বশর্ত পূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে সিইসি একজন মুক্তিযোদ্ধা, এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় কোয়ালিফিকেশন। তিনি সচিব হিসেবে অবসরের পর একদম বিস্মৃতির মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে খুব একটা কারো জানা ছিল না। বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা যাঁদের আছে তাঁরা কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে ধীরস্থির, সৌম্য, শান্ত ও প্রশান্তিময় অবয়ব রক্ষা করে চলতে পারেন। সবচেয়ে কঠিন সময়ে লক্ষ্যে অটুট থেকে কর্মসম্পাদন করতে হবে এমন একটি চ্যালেঞ্জিং পদের নামই প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আমার বিশ্বাস, তিনি তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির দ্বারা সব বিতর্ক এড়িয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রশংসনীয় সূচনা বক্তব্য সেদিন দিতে পারতেন। এটা অসম্ভব কিছু ছিল না। তিনি কেন বিএনপির প্রপাগান্ডায় পা দিলেন বুঝতে পারছি না। তাহলে কি তিনি বিএনপির হুমকি-ধমকিতে ভয় পেয়ে গেলেন। শুধু তো শুরু। এর চেয়ে আরো বহুগুণ কঠিন সময় আগামীতে নির্বাচন কমিশনের জন্য অপেক্ষা করছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]
image-id-664287
রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে বৈশ্বিক অবরোধ জরুরি
image-id-664116
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার পরিকল্পনা সফল হবে?
image-id-663754
জঙ্গি তৎপরতা কি দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হচ্ছে
image-id-663671
ট্রাম্পের বিজয় মার্কিন ইতিহাসের ট্র্যাজেডি