মোস্তাফিজুর রহমান – খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৭: আমাদের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিপ্লবের সঙ্গে সমান তালে বেড়ে চলেছে খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা ইত্যাদি অপরাধের ঘটনা।
আরও উদ্বেগজনক বিষয়, খুন, ধর্ষণ, প্রতারণার ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ঘটছে ভিকটিমের আপনজনের হাতে! জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে বাবা খুন, ভাতিজার হাতে চাচা খুন, যৌতুক বা নেশার টাকা না পেয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, অবৈধ সম্পর্কের কারণে দুলাভাইয়ের হাতে শালিকা খুন, মায়ের হাতে সন্তান খুন, বাবার হাতে শিশু খুন, বাবার দ্বারা মেয়ে বহুবছর ধরে ধর্ষিত, চাচার কাছে ভাতিজি ধর্ষিত ইত্যাদি খবরে প্রতিদিনকার পত্রিকা ঠাসা।
এ জাতীয় অপরাধের ঘটনা কমার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পূর্বের যে কোনও সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এমন সংবাদ বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর ছাপার জন্য বিশেষ পাতাও সৃষ্টি হয়েছে!
সুইডেন, নেদারল্যান্ডস অপরাধী না পেয়ে যেখানে কারাগার বন্ধ করে ভবনগুলোকে স্কুল বা লাইব্রেরি বানিয়ে দিচ্ছে, যেখানে আমাদের অপরাধীর সংখ্যা এত বাড়ছে যে অদূর ভবিষ্যতে স্কুল বন্ধ করে কারাগার বানাতে হতে পারে। আবার অপরাধীদের সিংহভাগ যেহেতু আপনজন, তাই এদের জন্য পত্রিকার খুন ধর্ষণের অঘোষিত বিশেষ পাতার মতো বিশেষ কারাগার তৈরি করে নাম দেওয়া যেতে পারে ‘আপনজন কারাগার’।
গত ২১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় যৌতুকের টাকা নিয়ে ঝগড়ার পর ২৫ বছর বয়সী গৃহবধূ বুলবুলি খাতুনকে স্বামী, শাশুড়িসহ শশুরবাড়ির লোকজন নির্মম নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। ঘটনাটি আকস্মিক ঘটে গেছে এমন নয়, দীর্ঘ দুই বছর ধরে বুলবুলির বাবার কাছে যৌতুকের দাবি করে আসছিল প্রভাবশালী স্বামী রইচ উদ্দিন। টাকা না পেয়েই এই হত্যাকাণ্ড। শুধু তাই নয়, হত্যার পর মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে অপপ্রচার চালায় তারা।
এই ঘটনার ঠিক দুই দিন পর ২৩ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় রফিক মিয়া ১৫ বছরের বিবাহিত স্ত্রী নাছিমা বেগমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করে। বাধা দিতে গেলে শাশুড়ি ও শিশু শালিকাকে কুপিয়ে জখম করে। কারণ হিসেবে রফিক মিয়া বলে নাছিমার চরিত্র খারাপ, তাই তাকে শেষ করে দিয়েছে!
একই দিন খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় জুয়া খেলায় বাধা দেওয়ায় বিবাহিত স্ত্রী জান্নাত বেগমকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে জুয়াড়ি স্বামী মোকলেছ মিয়া। এর আগে কয়েক দফা জান্নাতের বাবার কাছে থেকে সে যৌতুকের টাকাও নিয়েছে।
পরদিন ২৪ অক্টোবর, বিয়ের ১ বছর না পুরতেই মাত্র ৭ মাসের মাথায় যৌতুকের টাকার জন্য পাবনার বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে স্বামী ও শশুরবাড়ির লোকজনের হাতে শারীরিক নির্যাতনের পর খুন হয় ১৮ বছর বয়সী রোজিনা খাতুন নামের আরও এক গৃহবধূ।
ঠিক তার পরদিন ২৫ অক্টোবর নেশার টাকা না পেয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রী শিপ্রা রানী দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে পাষণ্ড স্বামী মানিক দাস।
ভিকটিমের জন্য সমবেদনা আর আসামিদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করার পূর্বে আলো ফেলা প্রয়োজন তাদের অতীতের দিকে। অনুসন্ধান করা দরকার নিজের সাজানো সংসার ভাঙতে কেন এই আপনজনেরা নৃশংস হয়ে উঠছে।
বুলবুলি, জান্নাত, রোজিনারা খুন হয়েছে যৌতুকের টাকার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় যৌতুকের টাকা নিয়ে আলাপ হয়। তখন উভয়পক্ষ নতুন দম্পতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে খুশি মনে এই ভয়ংকর বিষফোড়াকে প্রশ্রয় দেয়। ভাবা হয়, মেয়ের সুখ, নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য মেয়ের বাবা জামাইকে কিছু টাকা দিলে সে তো তার মেয়ের সংসারের উন্নতিতেই কাজে আসবে! অথচ এই সুখ, নিরাপদের অর্থমূল্য দর কষাকষির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। অনেক সময় বিয়ের আলাপ চলাকালে যৌতুক নিয়ে কোনও কথা হয় না, কিন্তু বিয়ের দিন হাজার হাজার অতিথির উপস্থিতির মধ্যে কনের বাবাকে গোপনে যৌতুকের প্রস্তাব করা হয়।
আমাদের দেশে মেয়ে বিয়ে দেওয়াকে বলা হয় কন্যা দায়, অর্থাৎ কন্যার পিতারা বহুবছর ধরে বিশ্বাস করেন কন্যা তার কাছে বোঝা! ভালো ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে হলে তাকে কিছু বিষয় মেনে নিতেই হবে! আর তাই মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে এমন অনৈতিক, অনভিপ্রেত অপরাধকে অবলীলায় পিতা বা অভিভাবকেরা প্রশ্রয় দিয়ে বসে, যা পরবর্তীতে জীবন মরণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আসলে কলহ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত, এমনকি খুন, জখম হওয়ার আগ পর্যন্ত যতবারই যৌতুকের দাবি করা হোক না কেন, এটাকে ঠিক যৌতুক বলে সম্বোধন করা হয় না। আমরা কোনও ভয়ংকর কিছু ঘটে যাওয়ার পরই যখন সংবাদ প্রকাশ করি তখনই কেবল এই বিষফোড়াকে যৌতুক বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
বিচক্ষণ হলে যৌতুক নিয়ে বিয়ের সময়ই অনুধাবন করা সম্ভব। কেবল গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তাছাড়া বিয়ের সম্পর্কের স্বামী আপন স্ত্রীর হত্যাকারি হয়ে উঠতে পারে, এই নেতিবাচক ধারণা নিয়ে তো আর কেউ বিয়ের মতো শুভ কাজ শুরু করে না। সুতরাং সবদিক দিয়ে যৌতুক চাওয়াকে শুরুতে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যা কন্যা পক্ষের সবচেয়ে বড় ভুল।
সুতরাং যৌতুকের প্রতিশ্রুতি কাঁধে নিয়ে কখনও মেয়ে বিয়ে দেওয়া উচিত না, প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে বিয়ের আগেই বিষয়টার যথাযথ সুরাহা করে এগোনো উচিত।
অবশ্য যাদের জন্য এই নিবন্ধ লিখছি, আদৌ তাদের কাছে এই কলাম পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আমি তরুণ প্রজন্মকে আহবান জানাই, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। তোমরা চাইলে নিজ নিজ এলাকায় যৌতুক বিরোধী সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে পারো, যা হয়তো আর কোনও বুলবুলি, জান্নাত বা রোজিনারা জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে।
এবার আসি মৌলভীবাজারের রফিক মিয়ার কাছে, যে তার ঘুমন্ত স্ত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেছে। আমি রফিক মিয়ার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। কিন্তু তার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুব জরুরি।
রফিক মিয়া কি পেষাদার খুনি? তিনি কি ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনের শেষে এখন থেকে একা থাকতে চেয়েছেন? তিনি কি তার ৪ সন্তানকে এতিম করতে চান? তিনি কি ১৫ বছরের বিবাহিত স্ত্রীকে সরিয়ে নতুন কাউকে ঘরে আনতে চান? তিনি কি নিজের এতদিনের সংসার ধ্বংস করে ফেলতে চান? তিনি কি ৩৫ তম বছর বয়সে এসে নতুন জীবন শুরু করতে চান? তিনি কি কোনও বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে চলেছেন?
আমার বিশ্বাস, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে রফিক মিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রয়োজন নেই। যে কোনও মানুষই এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তরে জানেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে রফিক মিয়া নিজের স্ত্রীকে কেন খুন করলেন?
একটি প্রতারণা ধ্বংস করে দিয়েছে নিম্নবিত্ত ১৫ বছরের সংসারকে। ৪ টি শিশু এতিম হয়েছে! খুনের দায়ে পিতা এখন কারাগারে, শিশুগুলো দিকভ্রান্ত। এরচেয়ে ভয়াবহ গল্প আর কী হতে পারে আমি জানি না।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বিয়ের পর কেউ আর এককভাবে ‘আমি’ থাকে না, দুজনে মিলে হয়ে যায় ‘আমরা’। সুতরাং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখা যেমন জরুরি, পরস্পরের বিশ্বাসের মূল্য দেওয়াও তেমন জরুরি। পরিবারগুলোকে আরও যত্নবান হতে হবে আর সচেতনতা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে, যেন আমরা ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলতে পারি সুন্দর এই পৃথিবী।
লেখক: সাহিত্যিক