ওয়ালিউর রহমান – খােলা বাজার২৪। বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭: বেগম জিয়ার বক্তব্যে নতুন কিছু নেই। তিনি যে কথাগুলো এতদিন বলে আসছিলেন সেই কথাগুলোরই পুণরাবৃত্তি করেছেন। একজন গণতন্ত্রমনা নেতা নির্বাচনে আসার জন্য কোনো কন্ডিশন দেন না। যে কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আসতে পারেননি এবং না আসতে পারার কারণে তিনি এবং তার দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, তাদের রাজনৈতিক জীবনে বড় একটা ভুল ছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। সেই আধাঘন্টার ফোনালাপে বেগম জিয়া কথা বলেছিলেন, ২৬ মিনিট। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সাড়ে তিন মিনিট। বেগম জিয়া যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেটা সারা পৃথিবীর মানুষ শুনেছেন।
বেগম জিয়া আবার বলছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। গতবারের নির্বাচনেও তিনি একইকথা বলেছিলেন। তখন তাকে নির্বাচনে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আসেন আওয়ামী লীগ বিএনপি মিলে একটা সরকার করি। প্রয়োজনে আপনি স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেন।’ যে মন্ত্রণালয় দুটো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের জন্য। কিন্তু বেগম জিয়া বলেন, ‘ আপনাকে পদত্যাগ করতে হবে।’
বেগম জিয়ার কাছে আমার একটা ছোট প্রশ্ন, তিনি কি দেখাতে পারবেন পৃথিবীর কোন দেশে পার্লামেন্টারি নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন? কোথাও না। নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করার পর যে সব প্রয়োজনীয় কাজ সেগুলো নির্বাচন কমিশন করবে এবং সরকার প্রজাতন্ত্রের যে সকল দৈনন্দিন কাজ রয়েছে সেগুলো চালিয়ে যাবেন। এটা পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশেই হয়ে থাকে। এটা ভারত করে, এটা যুক্তরাজ্য করে, এটা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে প্রেসিডেন্সি সরকার থাকা অবস্থায় নির্বাচন হয়। একই সঙ্গে আমরা চাইব এবং সরকারও নিশ্চই চায়Ñ বেগম জিয়া এবং তার দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বহুবার বলেছেন।
গণতন্ত্র হলো একটা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট। যে কন্ট্রাক্টটা করা হয় জনগণের সঙ্গে, ভোটারদের সঙ্গে। যে দলকে দেশের জনগণ পছন্দ করবে সেই দল ক্ষমতায় আসবে। এই সত্যটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। যদি না মানা হয় সেক্ষেত্রে বহু অনাকাক্সিক্ষত ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনে আসার ষড়যন্ত্র হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা বাংলাদেশিরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে এই সত্যটি নির্মমভাবে উপলব্ধি করেছি।
২০১৪ সালে বেগম জিয়া নির্বাচনে না এসে তিনি বললেন প্রতিরোধ করবেন। প্রতিরোধের নাম করে তিনি জ্বালাও-পোড়াও করলেন, তিনি মানুষ মারলেন, পুলিশ মারলেন। তিনি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিলেন। তিনি তার গুন্ডাবাহিনী দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপরে অবর্নাতীত নির্যাতন চালালেন। মন্দির ভাঙলেন, হাজার হাজার গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করলেন। রেল লাইন ওপরে দিলেন এবং রেলের বগি জ্বালিয়ে দিলেন। দেশের স্বাধীনতার সময়ে দেশের শত্রুদের মারতে গিয়ে যদি দেশের কোনো সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকে সেটা অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে আমরা দেশের কোনো ক্ষতি করিনি। এভাবেই বেগম জিয়া দেশকে ভালবাসার প্রকাশ দেখিয়েছেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকা কাটিয়েছেন। মেজর জিয়া যখন তার একজনকে দিয়ে খবর পাঠালে তিনি সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশে যাননি। একটা গণতান্ত্রিক দেশে যা করা উচিত নয় তিনি তাই করেছেন। তার ক্ষমতার সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে, ১৭ আগস্ট সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা করা হয়েছে। উনার ক্ষমতার সময়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার করা হয়েছিল, এই তিনটি অপরাধের বিচারকার্য এখনো চলছে। এ সবকিছুই একটি অগণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয়। তিনি যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনই এসব অপরাধ করা হয়েছে এবং তিনি কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তিনি বাংলার ইতিহাসে জঘন্যতম কাজটি করেছিলেন। শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা করলেন, সর্ব শক্তিমানের মহিমায় সেই হামলায় বেঁচে যান। সেই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ আরও অনেক নেতা-কর্মী মারা গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এই হামলার জন্য জজ মিয়া নামক নাটক সাজালেন। তিনি বর্তমান দশকে যা বলেছেন এবং করেছেন তা গণতান্ত্রিকমনা মানুষ হয়তো ভুলে যাবেন, কিন্তু ইতিহাস এটা ভুলবে না। বেগম জিয়ার নাম বাংলার ইতিহাসে কিন্তু ঠিকই রয়ে যাবে। জার্মান ঐতিহাসিক জধহশব সঠিকই বলেছেনÑ ‘রাজনীতিবিদরা যা করেন তারা ভাবেন যে, এটা কেউ মনে রাখবে না, কিন্তু তারা ভুলে যান। ইতিহাস কিন্তু এগুলো ভুলে না’।
বেগম জিয়ার কাছে আমি আবেদন করব আপনি একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা বলুন। যেগুলো অসম্ভব সেগুলো না বলে সঠিক কথা বলেন। ইতিহাস যদি দেখা হয়, বেগম জিয়াকে ইতিহাস হয়তো কিছু শিক্ষা দিতে পারে।
পৃথিবীর সব দেশেই ইভিএম পদ্ধতি চালু আছে। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে এই সিস্টেম চালু আছে। এ সম্পর্কে কোথাও কোনো আপত্তি শুনিনি। নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের সবচেয়ে মূল হাতিয়ার। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র অচল হয়ে যায়। যখন সাংবিধানিক প্রয়োজন থাকবে সেই প্রয়োজনের তাগিদে নির্বাচন করতেই হবে।
বেগম জিয়া সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলেছেন। সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপের সময় আমি যে কথা বলেছিলাম সেটার পুনরাবৃত্তি করছি। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌম এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে বাংলার মাটিতে তাদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কাজেই সেনাবাহিনীকে আমরা কোনো বিতর্কের সঙ্গে জড়াতে চাই না। এজন্য সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে ল এন্ড অর্ডার ফোর্স হিসেবে রাখাটা সমীচীন হবে না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে নির্বাচন অফিসারের অনুমতিক্রমে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা যেতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তাদের ডাকা যেতে পারে। নির্বাচন অফিসার যদি প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তাদের ডাকা হবে।
বেগম জিয়াকে বুঝতে হবে গণতন্ত্র একটি ডেলিকেট, সংবেদনশীল মাধ্যম। যে মাধ্যমকে আমরা বলি অবাধ, সুষ্ঠু, সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করবে সেই দল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসবে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক এরাাড়হ যখন রোম সম্রাজ্যের ইতিহাস লিখছিলেন। তিনি একটি বাক্য দিয়ে শুরু করেছিলেন। মানব ইতিহাস কী? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেনÑ দঐঁসধহ যরংঃড়ৎু রং ধ ৎবমরংঃবৎ ড়ভ যঁসধহ ভধষষরহম, পৎরসব ধহফ সরংভড়ৎঃঁহব.’ রোমানদের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি আরও অনেক কথা বলেছেন। তার বক্তব্যে যে জিনিস প্রতীয়মান হয় যে তার মনে একটি জিনিস ঘুরেফিরে এসেছে, যদি কিছু ভাল উপায় খুঁজে পাওয়া যেত যে, দেশের প্রত্যেকটি মানুষ, প্রত্যেকটি নাগরিক যেন একই অধিকার পায়। তারা কথা বলতে ও জানাতে পারে এবং তারা যেন একই শাসন পায়। সেই ম্যাগন কার্টার থেকে শুরু করে ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে গণতন্ত্রের ইতিহাস শুরু হলো। আমি এ কথাগুলো বললাম বেগম জিয়ার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বক্তৃতার পর। আমি দুঃখ পেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। কারণ মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তিনি অতীতে ভুল করেছেন, অন্যায় করেছেন। তিনি ইচ্ছেমতো দেশ চালিয়েছেন, বিরোধী দলের নেতাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। সীমান্ত খুলে দিয়ে বিদেশি শত্রুদের মাধ্যমে বহু ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এটা তার ঘড়ির নিচেই খোলা হয়েছিল। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার করেছেন, চাকরিচ্যুত করেছেন। আর্মিদের চাকরিচ্যুত করেছেন। সিভিল অফিসারসহ বিভিন্ন নাগরিকদের চাকরিচ্যুত করেছেন। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলেছিলেন।
আমি এই কথাগুলো তাকে বলছি, কারণ তিনি যেন তার জীবন সায়াহ্নে এসে শিক্ষা নিয়ে জীবনকে সরলায়ন করে। তিনি যেন এই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় ভ’মিকা রাখতে পারে। যাতে করে বাংলাদেশের মানুষ তাকে স্মরণ করে।
লেখক : গবেষক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক
– আমাদের সময়.কম