ড. ফোরকান উদ্দিন আহমদ – খােলা বাজার২৪। শনিবার , ২৫ নভেম্বর, ২০১৭: যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নেতৃত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোনো দল বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য পানে এগিয়ে নিয়ে উদ্দেশ্য অর্জনের প্রচেষ্টাকে নেতৃত্ব বলে। অন্য কথায় নেতৃত্ব বলতে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য অধীনস্থ লোকদের পরিচালনা করার এমন কৌশলকে বুঝায় যাতে দলীয় সদস্যরা তাদের সম্ভাব্য সর্বাধিক সামর্থ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হয়।বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী বিভিন্ন ভাবে নেতৃত্বের সংজ্ঞা দিয়েছেন। বৃহদায়তন সংগঠনে নেতৃত্ব বলতে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সাধনে কোনো সাধারণ কর্মপ্রচেষ্টায় একত্রে কাজ করতে মানুষকে প্রভাবিত ও উৎসাহিত করাই বুঝায়। মোটকথা, নেতৃত্ব হলো এমন একটি শক্তিশালী উপাদান বা কৌশল যা অধঃস্তন বিভিন্ন লোকের প্রকৃতি ও স্বরূপকে সামনে রেখে এদের এমনভাবে পরিচালিত করে যাতে সবাই আস্থার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলীয় এবং সাংগঠনিক উদ্দেশ্য অর্জনে তৎপর হয়।
বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে একজন মহান নেতা ও ব্যক্তির অবদান সর্বাগ্রে স্বীকৃত। তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণ যুদ্ধে নামে। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে একদিন এ দেশ স্বাধীন করে। স্বাধীনতার পর নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার দল আওযামী লীগ বিপুল ভোটে জয় হয় এবং সরকার গঠন করে। তারপর এ সরকার মোট সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল। পরে এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটে। শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। এ ক্যারিশমেটিক নেতার মৃত্যুর ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
অর্থাৎ এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতার গুরুত্ব কতখানি। এছাড়াও বাংলাদেশের মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের এ সমস্যা আছে অর্থাৎ এ বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়। যেমন ভারতে কংগ্রেসের ভাঙন, বিজেপির মতো দল গড়ে উঠা, ক্ষমতা লাভ করা এসবগুলোই সম্ভব হয়েছে কেবল জওহরলাল নেহেরুর মতো ক্যারিশমেটিক নেতারা নেই বলে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই এ অবস্থাটা দেখা যায়।
জন্মগতভাবে কেউ নেতা হয় না, নেতার উদ্ভব ঘটে। নেতা আর্বিভূত হন নেতার গুনাবলী দিয়ে। অন্যথায় তার অনুসারি গোষ্ঠী তাকে বুঝাতে, অনুসরণ বা সমর্থন করতে পারে না। নেতা সম্পূর্ণভাবে অন্যদের নিকট হতে পৃথক এই কারণে নয়, বরং তিনি অনেকাংশ অন্যদের সদৃশ ও তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে কাজ করে এগুলোর প্রসার ঘটাতে পারেন। এ কারণেই তিনি নেতৃত্ব দান করেন। অনেক রাজনৈতিক নেতারই উচ্চমাত্রায় সামাজিক সচেতনতা রয়েছে বলে মনে হয়, এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে তাদের আশেপাশে যা ঘটছে তারা তা উপলদ্ধি করেন। রাজনৈতিক আবহাওয়া অনুভব ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পেশকৃত বিশেষ দাবি দাওয়ার ফলাফল পরিমাপ করার সামর্থ্য রাজনৈতিক নেতার থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।ব্যাপকভাবে লোকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করার দক্ষতা উচ্চমাত্রায় নেতার থাকে বলে ধরে নেওয়া হয়, যাতে তিনি প্রায় সহজভাবেই একটির পর একটি ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যের সাথে তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা করতে সমর্থ হন।
দেশের কোনো অন্তিম মুহূর্তে অর্থাৎ কোনো গণঅভ্যূত্থান বা আন্দোলনের যদি দরকার পড়ে তবে নেতার সম্মোহনী শক্তি তখন খুব কাজ করে। অভিনেতার মত কণ্ঠ, সুলেখকের ন্যায় লেখনী শক্তি বা বিরাট দুঃসাহসিক আন্দোলনের নাটকীয় আচরণ করার ক্ষমতা ইত্যাদি থাকলে তাকে সাধারণ মানুষ অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বলে গণ্য করবে। তার কথামতে গণআন্দোলন করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নেতা যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের সঙ্গে থাকবেন। তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির মোকাবেলা করবেন। নেতা সবসময় জনগণের প্রতি উদার হবেন। তার উদারতা বিচক্ষণতা, ইত্যাদি গুনাবলী থাকলে মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
পৃথিবীতে যত নেতা জনগণের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তাদের উদারতা বা বিচক্ষণতার অভাব ছিল না। আমাদের রাজনীতিতে কোনো রাজনীতিবিদই নেতা হতে পারবে না যদি তার বিচক্ষণতা না থাকে, মানুষকে বুঝানোর ক্ষমতা থাকে না। জনগণকে সব বিষয়ে অবগত করে তুলতে নেতার দরকার। জনগণের কি অধিকার আছে তা চাইতে পারে। তারা একটা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কি দায়িত্ব পালন করবে এসব বিষয়ে জনগণকে শিক্ষা দেয় নেতা। নেতৃত্ব ছাড়া কোনো সময় কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না, গড়েও উঠতে পারে না। আমাদের ৯০ এর আন্দোলন, ৬৯ বা আমাদের স্বাধীনতা সব আন্দোলনই গড়ে উঠে নেতৃত্ব দ্বারা। নেতৃত্ব ছাড়া আন্দোলন গড়ে তুলা যায় না। তাই সঠিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষাদান খুবই অপরিহার্য। তারা রাজনৈতিকভাবে দক্ষ হতে পারে না নেতৃত্ব ছাড়া।
জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তুলতে নেতৃত্ব দরকার। সরকারের প্রতি জনগণের অনেক দাবি, আশা-প্রত্যাশা থাকে। তবে তারা তাদের দাবির কথা সরকারকে বা প্রশাসনকে জানাতে পারে না। একজন নেতার দ্বারস্থ হয়ে তাদের কথা সরকারকে জানাতে হয়। জনগণকে কোনো একটা দাবির ক্ষেত্রে সংগঠিত করে রাজনৈতিক নেতা। এমন অনেক নেতা থাকেন যাদের কথা শুনে জনগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে সবই এভাবে হয়েছে।
সতুরাং বলা যায় যে, একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে সে দেশের নেতৃত্বের উপর। বর্তমান বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে। এই পরিস্থিতিতে সঠিক নেতৃত্ব ও দেশপ্রেম সংকট কাটিয়ে উঠতে অনেক সহায়তা করবে।
যদি নেতৃত্ব সঠিক হয় তবে দেশের উন্নয়ন সুনিশ্চিত। কিন্তু বাংলাদেশের নেতৃত্বের বিকাশ বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, ফলে নেতৃত্বের সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকটময় পরিস্থিতিকে উন্নত ও সুশৃঙ্খল করার জন্য দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। একজন সুযোগ্য নেতা একজন ভালো পথ প্রদর্শক। তার নির্দেশের উপর দেশের ভালো-মন্দ অনেক কিছু নির্ভর করে। সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক কল্যাণে একজন যোগ্য নেতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকেন।
লেখক : উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি একাডেমি (পিআরএল), সফিপুর, গাজীপুর
-আমাদের সময়.কম