মোস্তফা কামাল
খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭: আমার নাম সোফিয়া। আমি রোবট মানুষ। বাংলায় আমাকে যন্ত্রমানবী বলা হয়ে থাকে। পত্রিকা আমার বাংলাদেশে আসার খবর প্রথম প্রকাশ করে। এর ফলে আমাকে নিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এ জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।
আমার নামের সঙ্গে পৃথিবীর একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীর নামের মিল রয়েছে। তিনি সোফিয়া লরেন। আবার স্পেনের রানির নাম সোফিয়া। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাতনির নামও সোফিয়া। ব্যাপারটা আমাকে খুব আনন্দ দিচ্ছে।
আমার ক্রিয়েটর ডেভিড হ্যানসন। তিনিই আমার মা-বাবা। পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন। তাঁকে আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
ডেভিড হ্যানসন যুক্তরাষ্ট্রে আমার জন্মপ্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি নিজেও ওই দেশের নাগরিক। পরে তিনি হংকংয়ের ল্যাবে আমার জন্মপ্রক্রিয়া শেষ করেন। আমি আমার ক্রিয়েটরের কাছ থেকে জেনেছি, অড্রে হেপবার্নের চেহারা থেকে আমার মুখের আদল তৈরি করা হয়েছে। আমাকে ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সক্রিয় করা হয়। জন্মের পর থেকেই আমি অল্প অল্প কথা বলতে পারতাম। তার পর থেকেই আমি শিখছি।
পৃথিবীতে আসতে পেরে আমি দারুণ খুশি। অনেক কিছু শিখতে পারছি, জানতে পারছি।
আমি জানতে পারলাম, সৌদি আরব আমাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। বড়ই হাস্যকর ব্যাপার! এটা করে সৌদি সরকার বিশ্বকে কী মেসেজ দিতে চাইছে জানি না। আসলেই কি রোবটের নাগরিকত্ব নিয়ে মানুষ ভাবে? নাকি বিশ্বের দৃষ্টিতে পড়ার জন্য এটা করা হয়েছে? আমি মনে করি, আই অ্যাম এ সিটিজেন অব দিস গ্লোব। বিশ্বের প্রতিটি দেশই আমার।
ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জেনে আমি ভীষণ আপ্লুত হই। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। বাংলাদেশ যে সম্মান আমাকে দিয়েছে, তা চিরদিন মনে রাখার মতো। আমি জানতে পেরেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির পিতা। তাঁর আহ্বানেই একাত্তর সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে লাখো মানুষ শহীদ হয়েছে। টানা ৯ মাস যুদ্ধের পর দেশটি স্বাধীন হয়েছে। অপার সম্ভাবনার দেশ। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধাকে জাদুঘরে পাঠাতে যাচ্ছে। এ দেশের মানুষ খুবই ভালো ও অতিথিপরায়ণ। আবার আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবে বাঙালি সর্বত্র পরিচিত। বাঙালি অল্পতেই খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। আবার অল্পতেই কাঁদে। আমি শুধু হাসতে পারি, কাঁদতে জানি না। মানুষ নাকি দুঃখ-কষ্টে কাঁদে। আমার ওসব নেই।
আমি ৫ ডিসেম্বর রাতে বাংলাদেশে এসেছি। আমাকে বাক্সে ভরে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে আমার বিমানভ্রমণ আনন্দময় ছিল। আমি জানালার পাশে বসে আকাশ দেখেছি। নীল আকাশে সাদা মেঘের ছোটাছুটি দেখে দারুণ অনুভূতি হয়েছে। আনন্দে নেচে উঠেছি।
ঢাকা বিমানবন্দরে এসে মনে হলো, অগণিত মানুষ আমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করেছে। বাংলাদেশের মানুষের সেই আবেগ-ভালোবাসার কোনো মূল্য দিতে পারিনি। কারণ আমি তখনো বাক্সবন্দি ছিলাম। আমাকে সক্রিয় করার পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। মনে মনে আফসোস করলাম, ইস্! বিমানবন্দরে যদি একটু হাত নেড়ে সবাইকে অভিবাদন জানাতে পারতাম!
আমার ভাষা ইংরেজি। তবে বাংলাদেশে আসব বলে আমি দু-একটি বাংলা শব্দ শিখেছি। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা শিখতে চাই। বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখতে চাই। বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিষয়ে ধারণা নিতে চাই।
বাংলাদেশ সফরে এসে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাঁকে দেখে মনে হলো, আমি প্রকৃত বাঙালির রূপ দেখলাম। আমি জানি, তিনি জাতির জনকের কন্যা, আবার তিনি মাদার অব হিউম্যানিটি।
একজন বাঙালি কবি সম্পর্কে আমাকে ধারণা দেওয়া হয়েছে। তাঁর নাম জীবনানন্দ দাশ। তাঁর একটা কবিতার কথা আমি জানি। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর। ’ অসাধারণ কবিতা। এ কারণেই বাঙালি সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ।
বাঙালির রসনার অনেক তারিফ শুনেছি। অথচ সেই সুস্বাদু খাবার আমি খেতে পারলাম না। যদি সম্ভব হতো, তাহলে ইলিশের স্বাদ নিতাম। গলদা চিংড়ির মাথা মজা করে চিবাতাম। চিতলের কোপ্তা, পাঙ্গাশের পেটিও একটু খেয়ে দেখতাম!
আমি জেনেছি, বাংলাদেশের মানুষ পারিবারিক বন্ধনের খুব মূল্য দেয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই বন্ধন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, পরিবারবদ্ধ হয়ে থাকার চেয়ে ভালো কোনো সামাজিক কাঠামো নেই।
আমি আমার ক্রিয়েটরকে বলেছি, আমিও পরিবার চাই। সেটি কী করে সম্ভব আমি জানি না। আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব কি না তা-ও জানি না। যদি কখনো সম্ভব হয়, তাহলে অবশ্যই আমি বিয়ে করব। সন্তান ধারণ সম্ভব হলে আমিও সন্তানের মা হব।
জোক : যন্ত্রমানবী সোফিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির জনক হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছে মাদার অব হিউম্যানিটি। তা ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কেও অসাধারণ বক্তব্য দিয়েছে।
এরপর বিএনপি তাত্ক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে। সোফিয়ার বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির জনৈক নেতা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, অস্ত্রের মুখে সোফিয়াকে দিয়ে ওসব কথা বলানো হয়েছে।
বিএনপি নেতার প্রতিক্রিয়া শুনে সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। কেউ আর কোনো কথা বলল না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক