খােলা বাজার২৪। শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ২০১৫ ও ২০১৬ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সন্দেহাতীত প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এ প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছিল ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের ‘পিপলস প্রেসের’ এক কর্মচারী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ। এখান থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ছেপেছিল। চলতি বছর একই ইউনিটের পরীক্ষায় ঘটেছে ডিজিটাল জালিয়াতি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের এক কোটি ৪০ লাখ টাকার খোঁজ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনায় গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পিপলস প্রেসের কর্মচারী খান বাহাদুর (২৮), নাটোর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রকিবুল হাসান ইসামী (২৮), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গত তিন মাসে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই চক্রের আরও অন্তত ২০ জনকে খোঁজা হচ্ছে। সংস্থাটির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান। কী করে পিপলস প্রেসকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ছাপার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, বুধবার জামালপুরে অভিযান চালিয়ে সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে গ্রেপ্তারর করা হয় খান বাহাদুরকে। তিনি ওই প্রেসের কর্মচারী। তার মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সূত্রপাত। সাইফুল ও বাহাদুরকে একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। তবে ডিজিটাল জালিয়াতির চেষ্টা করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছার কারণে জড়িতরা ধরা পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করবে এটা মেনে নেওয়া হবে না।
প্রেসের কর্ণধার যা বলছেন : পিপলস প্রেসের কর্ণধার মো. মামুন জানান, তার ওপর আস্থা রেখেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র ছাপার দায়িত্ব দিয়েছিল। তবে তার প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারীর মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে-এটা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। ২০১৭ সালে তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়নি বলে জানান তিনি।
যেভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস : ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ছেপে আসছিল পিপলস প্রেস। ওই প্রেসের তিন কর্মচারী হলেন জামালপুরের খান বাহাদুর, আমিনুর রহমান ও মোবারক হোসেন। ২০১৪ সালের দিকে খান বাহাদুরের আত্মীয় সাইফুল ইসলাম গ্রাম থেকে এসে ফার্মগেটে তার কাছে ওঠেন। তবে কিছুদিন পর সাইফুলকে খান বাহাদুর প্রেসে আসতে মানা করে দেন। এর পর সাইফুল উত্তরায় একটি মেসে ওঠেন। সেখানে তৎকালীন ক্যামব্রিয়ান কলেজের শিক্ষক রকিবুল হাসান ইসামীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে সাইফুল জানতে পারেন, খান বাহাদুরের প্রেসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা তিনি ইসামীকে জানান।
এর পর ইসামীর প্ররোচনায় সাইফুল প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে সহায়তা করতে খান বাহাদুরকে নানা প্রলোভন দিতে থাকেন। ২০১৪ সালে বাহাদুরকে টলাতে ব্যর্থ হন তারা। তবে ২০১৫ সালে বাহাদুরকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে পিপলস প্রেস থেকে ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই বের করে আনেন ইসামী ও সাইফুল। এর আগে ফার্মগেটের একটি মসজিদে গিয়ে তারা শপথ করেন, ঘটনাটি কখনও কারও কাছে কোনো চাপেই প্রকাশ করবেন না। ২০১৬ সালে বাহাদুরকে তিন লাখ দিয়ে আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়। ফাঁস করা এসব প্রশ্নপত্র টার্গেট করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়।
‘গুরু’ ইসামী : সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা রকিবুল হাসান ইসামীর বাবা নাটোরের একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। ইসামীর এক ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক। ইসামী ২০১৬ সালে ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। তবে প্রশ্ন ফাঁসের পুরনো বাণিজ্য থেকে নিজেকে সরাননি। তার সহযোগী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী বনি ইসরাইল, মারুফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র দেওয়ার ব্যাপারে দেনদরবার করতেন। এরপর ইসামী ও সাইফুলের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে তাদের কাছে সরবরাহ করা হতো। অনেক সময় পরীক্ষা শুরুর আগে প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হতো। বিভিন্ন সময় শুধু বনি ও মারুফ তাদের ‘গুরু’ ইসামীকে প্রশ্ন বিক্রির ৩৮ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। সাইফুলের স্ত্রী সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দেন ইসামী। কয়েকবার সাইফুলকে কক্সবাজারে ভ্রমণেও নিয়ে গেছেন তিনি। প্রশ্ন ফাঁসের টাকায় গ্রামের বাড়িতে গরুর ফার্ম দিয়েছেন সাইফুল।
তদন্ত ও গ্রেপ্তার অব্যাহত : সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কেউ জড়িত আছেন কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জালিয়াত চক্রের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আদালতের মাধ্যমে জব্দ করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন তারা।
গত ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে মহীউদ্দিন রানা ও আবদুল্লাহ আল মামুন নামে ইসামীর গ্রুপের দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এরপর ১ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক হোসেন রাফি ও ফারজাদ সোবহান নাফিকে। পরে গ্রেপ্তার করা হয় আনিন চৌধুরী, নাভিদ আনজুম তনয়, এনামুল হক আকাশ, নাহিদ ইফতেখার, রিফাত হোসেন, বায়েজিদ, ফারদিন আহম্মেদ সাব্বির, তানভি আহম্মেদ, প্রসেনজিৎ দাস, আজিজুল হাকিম, তানভির হাসনাইন, সুজাউর রহমান, রাফসান করিম ও আঁখিনুর রহমান অনিককে। প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) সহকারী পরিচালক অলিভ কুমারকেও খুঁজছে পুলিশ। প্রশ্নপত্র ফাঁস জালিয়াতির সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের কয়েক নেতার সংশ্নিষ্টতাও পাওয়া গেছে।
সূত্র : সমকাল