Wed. May 7th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

মনিজা রহমান – খােলা বাজার২৪। সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭: আমার নানী খুব ভালো সূচিকর্ম জানতেন। সেইসব সূচিকর্ম কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে বসার ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখতেন তিনি। ঘরের শোভা বাড়াতো সেই ফ্রেমগুলো। নানা বাড়িতে গেলে আমি খুব মন দিয়ে পড়তাম সেই লেখাগুলো। কোনোটাতে লেখা থাকতো- ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’, কোনোটায় ‘নদীর জল ঘোলাও ভালো/জাতের মেয়ে কালোও ভালো’। একটা লেখা তো আমার প্রায়ই মনে হয়- ‘প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে/কেঁদেছিলে একা তুমি/ হেসেছিল সবে/এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি/কাঁদিবে ভুবন’।

লাইনগুলো কোন কবির জানা নেই। কিন্তু জীবনের নানা উত্থান-পতনে আমার খুব মনে পড়ে কথাগুলো।

আমার নানা বাড়ি বরিশালে যে এলাকায় সেখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা খুব অনুন্নত হলেও, গ্রামটা একটা বিশেষ কারণে আদর্শ গ্রাম ছিল। গ্রামে একটি শত বছরের পুরনো হাই স্কুল আছে। বহু ছেলেমেয়ে ওই স্কুলে পড়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এসে ওই গ্রামে জায়গীর থাকতো। গ্রামের প্রায় সবাই কমবেশি লেখাপড়া জানতো। আমার নানা ও আমার আম্মার নানা দুজনেই স্কুলশিক্ষক ছিলেন বলেই শিক্ষার বীজটা ছিল আমার নানীর রক্তে। বহমান জীবনের বহু গূঢ়তত্ত্ব নিয়ে ভাবতেন আসলে আগের দিনের সেই মানুষেরা। আমার নানীও ছিলেন তেমন একজন।

ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পরে আমার নানীর হাতের সেই সূচিকর্মের কথা কেন যেন ক’দিন ধরে ঘুরে ফিরে মনে হচ্ছে। একজন মানুষের মৃত্যুর পরে এত এত মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ বহুদিন দেখিনি। কেউ তাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেছে, কেউ দূর থেকে দেখেছে, কেউ টিভিতে দেখেছে- কিন্তু সবার দেখার মধ্যে একধরনের মুগ্ধতা মিশ্রিত শ্রদ্ধা। ফেসবুকে প্রত্যেকের আবেগময় অনুভূতির প্রকাশ, অসম্ভব স্পর্শ করছিল আমাকে। আমার ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জেনেছি, আনিসুল হক ব্যক্তিগত জীবনে নিজের পক্ষের হোক কিংবা বিপক্ষের হোক, সবাইকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। আদর্শ নেতা ছিলেন তিনি। প্রকাশ্যে- গোপনে কারো অমঙ্গল তিনি করতে জানতেন না। উনি স্বপ্ন দেখতেন দূরাগতের। স্বপ্ন দেখাতে পারতেন।

মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। আরো ভালোবাসে নায়ককে, খলনায়ককে নয়। তাই আমরা নিজেরা যত পচা, বাজে, স্বার্থপর-লোভী হই না কেন, আমরা ঠিকই নায়ককে দেখে মুগ্ধ হই। আনিসুল হক ঠিক তেমনই একজন নায়ক ছিলেন। আর ওই যে সব কথারও পর সেরা কথা- ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’- সেটা ওনার ছিল।

সেদিন এক ডাক্তারের অফিসে বসে আনিসুল হকের অকাল প্রয়াণের কথা ভাবছিলাম মনে মনে। নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্টে গেলে পাঁচ মিনিটের বেশি বসে থাকতে হয় না। কিন্তু জ্যাকসন হাইটসের বাঙালি ডাক্তাররা এখনও যেন বাংলাদেশেই থাকেন। চার-পাঁচ মিনিটের জন্য হয়তো দেখেন, কিন্তু বসিয়ে রাখেন এক থেকে দেড়ঘণ্টা।

সেদিনও বসে নানা বিষয় ভাবছিলাম, হঠাৎ সামনে দেখি এক পরিচিত মহিলা! ওনাকে দেখে রীতিমতো চমকে গেলাম। কারণ আগের দিন সকালে তার কথা বলছিলাম আমরা ক’জন বন্ধুরা মিলে। ধরা যাক ভদ্র মহিলার নাম ফারিয়া হোসেন। নামটা আধুনিক। ভদ্র মহিলার নামটাও বেশ আধুনিক, কিন্তু গোপনীয়তার স্বার্থে বললাম না।

আমি তাকে বললাম, ‘সেভেন্টি ফোর স্ট্রিটে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সেখানে আমার এক বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। কথায় কথায় আপনার কথা উঠলো। আপনি আগে যেখানে কাজ করতেন, সেখানে আমরা জন্মদিন উদযাপন করতাম। এখন আপনি নেই বলে আমরাও যাই না। সবাই মিলে সেই আলোচনা করছিলাম। আর আজই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল!’ ভদ্র মহিলাও খুব আনন্দিত হলেন আমাকে অনেকদিন পরে দেখে। ‘আপনারা যে আমাকে এতদিন পরে মনে রেখেছেন এইজন্য আমিও খুব খুশি।’

ব্যবহারে বংশের পরিচয়। এই ভদ্র মহিলার ব্যবহারের কারণে জ্যাকসন হাইটসের থার্টিসেভেন এভিনিউয়ের ওপরে একটি পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রায়ই খেতে যেতাম। উনি আমাদের দেখলে এত খুশি হতেন যে বলার নয়! হয়তো এটাও তার পেশাগত কৌশল, কিন্তু ওনার হাসিটা ছিল আন্তরিক! পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট হলেও এলাকার কারণে আগত ক্রেতাদের বেশির ভাগ ছিল বাংলাদেশি মানুষ। বিশেষ করে ক্যাশ কাউন্টারে বাঙালি এই ভদ্র মহিলার আন্তরিক-উষ্ণ ব্যবহার ছিল সবার রেস্টুরেন্টে যাবার অন্যতম কারণ।

একদিন হঠাৎ ওখানে গিয়ে শুনি ভদ্র মহিলাকে ‘ফায়ার’ করে দেয়া হয়েছে। মানে ছাঁটাই। এই দেশে হায়ার আর ফায়ার খুব সাধারণ ঘটনা। মালিক চাইলে যে কাউকে হায়ার কিংবা ফায়ার করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে মালিকের ফায়ারের কারণ ছিল ‘ঈর্ষা’! মালিকদের চেয়ে কর্মচারীর এত জনপ্রিয়তা তারা সহ্য করতে পারেন না। কর্মচারী কেন এত টিপস পাবে, এটা জ্বালাতো ওদের।

রেস্টুরেন্টটি চালাতো পাকিস্তানি এক দম্পতি আর তাদের ছেলে। তারা রেস্টুরেন্টের নিচে বেসমেন্টে থাকতো। যদিও বেসমেন্টে বসবাস আইনত সিদ্ধ নয়। ওদের একমাত্র ছেলে ভদ্র মহিলা চলে যাবার পরে ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়ানো শুরু করলো। সেই ছেলের মুখে হাসিতো দূরের কথা, মনে হতো পৃথিবীর তাবৎ বিরক্তি যেন তার চোখে-মুখে। আমার বাসা থেকে সবচেয়ে কাছের রেস্টুরেন্ট হওয়ায় মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে যেতাম সেখানে। গেলেই দেখতাম ওই ছেলেটির গোমড়ামুখ। আমার শিশু সন্তানদের সঙ্গেও ওর ব্যবহার রূঢ়, নিষ্পৃহ, আন্তরিকতাবর্জিত। যেটা এদেশের মানুষ কখনই করে না।

পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টের উল্টোদিকে আরেকটি বাঙালি রেস্টুরেন্ট দারুণ জমে উঠেছে বছরখানেক হলা। তাই এখন আর সেই পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে জমজমাট ভাব নেই। শোনা গেছে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। থার্টিসেভেন এভিনিউয়ের ওপরে ইলেকট্রনিক্স জিনিসের একটা দোকানেরও প্রায় একই ঘটনা। একবাঙালি কর্মচারীর জন্য প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি ক্রেতা ছিল দোকানটির। আগে ভাবতাম, এই পুরুষ কর্মচারী হয়তো দোকানের মালিক। ভদ্রলোক অসম্ভব করিৎকর্মা ছিলেন। আর খুব আন্তরিক ছিল তার ব্যবহার।

একদিন দেখি দোকানের পাকিস্তানি মালিকও ক্যাশকাউন্টারে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। কিছুদিন পরে দেখি, বাঙালি সেই ভদ্রলোক আর নেই! দাম্ভিক পাকিস্তানি মালিক ক্রেতাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারতো দূরের কথা, একটার পরে দ্বিতীয় কথা বলতে চান না। দোকানে আগত কেউ যদি কোনো কিছুর দাম জিজ্ঞাসা করে, তাতেও তিনি বিরক্ত হন। না কিনলে দাম জানতে চাওয়াও যেন একটা অপরাধ। আর তারপর থেকে ক্রেতা কমতে লাগলো ইলেকট্রনিক্স দোকানটির।

জ্যাকসন হাইটসে ভারতীয় ও পাকিস্তানি দোকানে বাঙালি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। কারণ ক্রেতাদের সিংহভাগ বাংলাদেশি। ভারতীয় মালিকরা পেশাদারী আচরণ করলেও পাকিস্তানিরা কেন যেন সেটা করতে চায় না। তারা হয়তো বাঙালির উন্নতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানিদের ব্যবহারে প্রকাশ পেয়ে যায় তাদের আসল পরিচয়।

ফারিয়া হোসেন (ছদ্মনাম) নামে ওই ভদ্রমহিলা জানালেন, সাতদিন পরে তিনি বাংলাদেশে চলে যাচ্ছেন। ওখানে ওনার স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে আছেন। পরিবারে শুধু ভদ্রমহিলার আমেরিকার ভিসা আছে। উনি ভেবেছিলেন এখানে এসে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে ছেলেমেয়েদের আনবেন। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরে স্বামীকেও আনবেন। কিন্তু সেই সব কিছু না করেই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন দেশে। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন অনেক তিক্তস্মৃতি।

ডাক্তারের চেম্বারে সেদিনের কথোপকথনে ভদ্রমহিলা বেশ কয়েকবার ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ বাক্যটা বললেন। ‘আমরা এখানে এসে কাজ করতে পারি, কিন্তু ওদের চেয়ে অনেক ভালো বংশের মানুষ আমরা। ওই রেস্টুরেন্টের পাকিস্তানি মালিকরা থাকে বেসমেন্টে। আর ঢাকার উত্তরায় আমার নিজের বাড়ি আছে। আমার স্বামী সরকারি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমরা জানি মানুষের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। আর ব্যবহারে বংশেরপরিচয়।’

ওঠার আগে ভদ্রমহিলা পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে তার এক কষ্টদায়ক স্মৃতির কথা বললেন। একদিন ত্রিশটা নানরুটি একসঙ্গে ছুরি দিয়ে অর্ধেক করতে বলেছিল মালিক। কাটার সময় একটা রুটি নিচে পড়ে গিয়েছিল। সেটা দেখে পাকিস্তানি মালিক তাকে মারতে ছুটে এসেছিল। ভদ্রমহিলা তখন ওদের বলেছিল, এখানে সিসিক্যামেরা আছে। আমি আমেরিকার আদালতে মামলা করলে, কর্মচারীদের নির্যাতনের অপরাধে আপনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে ফেঁসে যাবেন। আপনাদের রেস্টুরেন্টও বন্ধ হয়ে যাবে।
ভদ্রমহিলার শেষের কথাগুলো শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছু মানুষ, মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তাদের ভেতরটা পশুরমতো অনুজ্জ্বল থেকে যায়। মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার কি হবে তারা সেটা জানে না।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে শপথ নিলাম, সারা জীবনের জন্য না হোক, অন্তত এই ডিসেম্বরে, এই বিজয়ের মাসে, কোনো পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো না। মানবজমিন