খােলা বাজার২৪। শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮: ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হবার পর কতবার যে আমরা বন্ধুরা আলাপ করেছি…”ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে জীবনটাই যেন অপূর্ণ থেকে যেত। আর হলে না থাকলে অর্ধেকটা অপূর্ণ থাকত।”….এমন কথা বলতে পারতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালবাসা আর আলাদা সম্মানবোধ থেকে। কেন এই ভালবাসা আর সম্মানবোধ এসেছিল? এগুলো এসেছিল অনেকগুলো কারণে। তার মধ্যে শিক্ষার মান, কিছু শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা দেয়ার ধরণ, ক্যাম্পাসের পরিবেশ, মেধাবি শিক্ষার্থীদের পদচারণা, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, ডিপার্টমেন্ট এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বাইরের লোকজনের পক্ষ থেকে সম্মান পাওয়া এগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য। গ্রামের অনেকেই আমাকে ‘নয়নমনি’ বলতেন কারণ আর কিছু নয়…ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বলে।
এগুলো যেন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগাতো। অনিরাপদ ঢাকা শহরে রাতের বেলায়ও নিশ্চিন্ত-নিরাপদ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। হলগুলোতে আমরা যারা থাকতাম…খুব কমই পূর্ব পরিচিত অথচ কত আপন হয়ে গিয়েছিল তারা সব। সত্যি কথা বলতে কী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান হলে ছিলাম থার্ড ইয়ার ফাইনাল পর্যন্ত। অথচ আমি ছিলাম বেসিক্যালি মুহসীন হলের ছাত্র। যশোরের এক বড় ভাই আমাকে তার সিটে থাকতে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে কেউ কোনোদিন কোনো কথা বলে নি। কত হৈ-হুল্লোড় করে থাকতাম হলে। সিনিয়র, জুনিয়র, আমরা বন্ধুরা। সে কী আন্তরকিতা!! বিশ্বিবদ্যালয় জীবন শেষ করেছিলাম অবশ্য মুুহসীন হলে থেকেই।
আজও মনে পড়ে মুজিব হলের ৫০২ নাম্বার রুমকে। আশপাশের জুুনিয়র ছেলেরা কতটা সম্মান করত!!….বড় ভাইয়েদের আদর কী কম পেয়েছি?? ক্যাম্পাস ছিল যেন প্রশান্তির জায়গা। ৫ বছরে এমন হয়েছিল যে, ছুটি উপলক্ষে বাড়িতে গেলে দু চারদিন পরই মন টানত ক্যাম্পাসে, হলে। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আজকাল যা ঘটছে তা ভাবলেও গা ঘিন ঘিন করে!! এতটা চুুলোচুলি, মেয়েদের এতটা নিকৃষ্ট কর্মকাণ্ড দেখি নি বা শুনি নি তখন। হ্যা, ক্যাম্পাস সন্ত্রাসমুক্ত ছিল না। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বাম সংগঠনগুলো সবাই সন্ত্রাসী পুুষত এবং আমরা তা পরিষ্কার জানতাম। আমাদের সময়ে হলগুলোর গেইটে পুুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকত এবং ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণে থাকা হলগুলোর গেইটে থাকতো সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের পাহারা। একইভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর দেখেছি ছাত্রলীগের ক্যাডারদের সশস্ত্র পাহারা। শিবিরের লোকজনকে দেখতাম গোপনে দলে লোক ভেড়ানোর তৎপরতাা। তাদেরকে অবশ্য, ঢাবি-তে সশস্ত্র দেখি নি। তবে আর যাই দেখি না কেন…ক্যাম্পাসে কখনো কোনো নারী বা মেয়ে ক্যাডার দেখি নি তখন। ছাত্র সংগঠনগুলোর নারী নেত্রীরাও ছিলেন আলাদা সম্মানের। কিন্তু এখন আর তা নেই….নিজেরাই তা খুঁইয়েছে।
আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি এজন্য সবার আগে দায়ী আমাদের রাজনীতির কর্ণধারেরা। তারাই এইসব পুষে চলেছেন বছরের পর বছর। রাজনীতির ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে তাদের প্রয়োজন হয়েছে পুরুষ ক্যাডার, নারী ক্যাডার। প্রয়োজন হয়েছে নোংরা শিক্ষক রাজনীতির। শিক্ষক রাজনীতির খেলায় প্রয়োজন হয়েছে ছাত্র ক্যাডারদের। এভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে। ক্যাম্পাস হয়ে গেছে মগের মুুল্লক। সে কারণে আজ ভিসিকে উদ্ধার করতে ছাত্রলীগ লাগে; প্রশাসনকে প্রয়োজন পড়ে না, প্রশাসনকে আস্থায় নেয়া যায় না! ছাত্রলীগের এই উদ্ধার তৎপরতার (!?) পক্ষে সাফাই গাইতেও লোকের অভাব হয় নাা। কিন্তু আমরা চোখের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবে মরে যেতে দেখব?? কীভাবে তা সম্ভব?? এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই হবে।
সেজন্য সবার আগে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। রাজনীতির শীর্ষ পর্যায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি অভিভাবকে তার সন্তান বা ভাই-বোনের খবর রাখতে হবে।…ক্যাম্পাসে কী করছে ছেলে, মেয়ে বা ভাই-বোন….সেটা জানা জরুরি। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মেধা ধ্বংস না করে লেখাপড়া করে তারা যেন মেধার বিকাশ ঘটায় সে ব্যবস্থা নিতেই হবে। অভিভাবক হিসেবে আপনার আমার দায়িত্ব আছে; সে দায়িত্ব আমরা পালন করছি কিনা আজই তা ভেবে দেখি। যেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-রাজনীতি নেই সেসব দেশে কী রাজনীতি চলে না? সরকার গঠন করে না? সেসব দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা সরকার কী আমাদের দেশের চাইতে দুর্বল?? ভেবে দেখুন তো!! তাহলে কেন আমরা আমাদের সন্তানদের বা ভাই-বোনদেরকে ছাত্র-রাজনীতি করতে দেব?? যে ছাত্র-রাজনীতি আমার সন্তানকে ভাই-বোনকে নষ্ট করছে কেন তা আমি করতে দেব?? আসুন সোজাসুজি ছাত্র-রাজনীতিকে না বলি। ( ফেসবুক থেকে )