কামাল লোহানী – খােলা বাজার২৪। সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে শ্লোগান ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ও সকল আঞ্চলিক ভাষার সমান মর্যাদা দিতে হবে। সকল রাজবন্দির মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।
একুশে ফেব্রুয়ারি তত্কালীন মুসলিম লীগ সরকারের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে যে মিছিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ (বর্তমানে জগন্নাথ হল) অভিমুখে যাত্রা করবে বলে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল এবং ঢাকা শহরের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবেত ছাত্র-ছাত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে হবে। বের হয় মিছিল। একের পর এক এই মিছিল পরিষদ অভিমুখে যেতে থাকলে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। হত্যা হলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। আরো কত অজানা শহীদের রক্তধারা গিয়ে মিশল সাধারণ মানুষের জীবনে, তারাও এই আন্দোলনে সামিল হলেন ছাত্রদের পাশে। তৈরি হলো ২১ শের চেতনা, সারা প্রদেশে ব্যাপ্ত হয়ে গেল।
আমরা সবাই বলি ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, আবার বলি ২১শে ফেব্রুয়ারি মুক্তির সোপান রচনা করেছে। কিন্তু আজ আমার একটি প্রশ্ন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানি হিংস্র শোষকদের কবল থেকে মুক্ত, যার রাষ্ট্রভাষা একমাত্র বাংলা। কিন্তু আমরা কি আজও সেই শহীদদের রক্তধারা শ্লোগান সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করতে পেরেছি? ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট এমনকি অফিস আদালতেও বাংলাভাষার চর্চা আমাদের চোখে শহীদদের সম্মান রক্ষা করার মতো করে দেখতে পাই না। তবে একটা বিষয়ে বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাই। তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা লিপি, বর্তমানে তাদের নিজ ভাষায় বই প্রকাশ করে বিতরণ করেছে এবং প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত মাতৃভাষার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয়, মাতৃভাষা বাংলাকে যথার্থ সম্মান দিয়ে চর্চা এবং প্রচলনের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে যে অনীহা তা দুঃখজনক।
রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় দোকানপাটে দেখি ইংরেজিতে সাইনবোর্ড লেখা। আমরা কি বাংলাভাষাকে ভুলিয়ে দিতে চাই? আর সে কারণেই মানুষের জীবনে নানা স্তরে বাংলাভাষাকে পরিহার অথবা প্রত্যাখ্যান করে চলেছে।
আজ বাংলাভাষার উপর ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা অথবা ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে বাণিজ্যিকীকরণের যে মতলব সহসাই দেখতে পাই, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি কোনো ব্যবস্থা না গ্রহণ করে তাহলে শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিদেশিদের দ্বারা ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালন করার সার্থকতা কোথায়? নিজভূমে বাংলা তো পরবাসী।
সুতরাং এই মর্মবেদনা ও আত্মসম্মানহীনতা থেকে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হলে সুমহান মাতৃভাষা যার ঐতিহ্য হাজার বছরেরও অধিক তাকে সুসমন্বিত চর্চা, প্রশিক্ষণ ও সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে, বিদ্যায়তনগুলোতে শুদ্ধ ভাষা প্রয়োগ ও বানান পদ্ধতি এবং উচ্চারণরীতি প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে তরুণ প্রজন্ম তারা আজ বাংলাভাষার বিকৃতির চক্রান্তে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। ভাষা বিকৃতিকে রোধ করার জন্যই রাষ্ট্র, সরকার, বিদ্যায়তন এবং পরিবারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
[ লেখক: সাস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব]