খােলা বাজার২৪। রোববার, ০৪ মার্চ, ২০১৮: ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞান যুগে যুগে ভালবাসার অসামান্য ব্যাখা দিয়েছে। মিসরীয় রাণী ক্লিওপেট্রা আর তাঁর সেনাপতি এন্টোনির প্রেমের বন্ধনে মিসর পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। গ্রীক প্রেমিকা পেনেলোপ ১০৮ রাজাকে প্রত্যাখান করে ২০ বছর অপেক্ষা করেন প্রেমিক অডিসিয়াসের জন্য, যেখানে ভালবাসার অপর নাম অপেক্ষা। রানী ভিক্টোরিয়া স্বামী স্বামী প্রিন্স আলবার্টের মৃত্যুর পর প্রায় ৪০ বছর পর্যন্ত তাঁর জন্য শোক করেছেন। অন্যদিকে মেরি ও তার স্বামী পিয়েরি কুরির প্রেম ছিল মানবতার কল্যাণে আর কাজের মধ্যেই।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা ভালবাসাকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন, স্বর্গীয়, বন্ধুত্বপূর্ণ, পারিবারিক ও প্রেমময় ভালবাসা। অন্যদিকে যেখানে অপরের কল্যাণ নিহিত তাই অ্যারিস্টেটলের কাছে ভালবাসা। বাট্রান্ড রাসেলের কাছে ভালবাসা নিরঙ্কুশ, তিনি ভালবাসাকে স্বজনকেন্দ্রীকতার ঘোর বিরোধীতা করেন। জীববিজ্ঞানি জেরেমি গ্রিফিথের মতে, ভালবাসা হচ্ছে নিঃশর্ত নিঃস্বার্থতা। অন্যদিকে প্রতিটি ধর্মেই মানুষ, সৃষ্টিকর্তার ও সৃষ্টিকে ভালবাসার কথা বলা হয়েছে, যা স্বগীয় ও নিঃস্বার্থ।
প্রাচীন রোমানদের কাছে আবেগ মানেই প্রেম বা যৌনতা। চৈনিক সংস্কৃতিতে কনফুসিয়াসের মতে, ভালবাসা হচ্ছে ‘কর্ম ও দায়িত্ব’। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বেদ মোতাবেক ভালবাসার আদি ব্যাখা ‘কাম’, যা শুধুমাত্র যৌনতা নয়, পার্থিব যে কোন ইচ্ছাকেই বোঝায়। পারসি সংস্কৃতিতে ‘ইশক’ শব্দটি পাওয়া যায়, যা বন্ধু, পরিবার, স্বামী-স্ত্রী এবং স্রষ্টার প্রতি ঐশ্বিক ভালবাসাকে বোঝায়।
আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার ভালবাসাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন- কামনা, আকর্ষণ ও সংযুক্তি। ফিশারের মতে, প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক এই তিনটি ধরনের যে কোনো একটি দিয়ে শুরু হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে তা পরিবর্তিতও হতে পারে। আবার একই সঙ্গে তিনটি ধরনই উপস্থিত থাকতে পারে।
১৯ শতক থেকেই মুক্ত ভালবাসা বা ফ্রি লাভ শব্দটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এটি বিয়ে ও সন্তানের ধারণাকে প্রত্যাখান করে। ‘উন্মক্ত যৌনতা’ শব্দটি ‘মুক্ত ভালবাসার’ ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে ব্যবহৃত হয়।
প্রথম দেখায় ভালবাসা একটি বিশেষ আবেদন রয়েছে। এটি অহরহই ঘটতে দেখা যায়। মানুষ বলে এটি সবসময়ই ঘটে। কিন্তু এই আবেগ শারীরিক বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি তীব্র অনুভূতি থেকে সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞান বলে, প্রথম দেখায় যে আবেগ বা প্রেমভাব অনুভূত হয় তা প্রকৃত অর্থে ভালবাসা নয়। এটি গভীর আকর্ষণ যা সম্পর্কের সম্ভাবনা তৈরি করে ।
মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্বমতে শরীরের উপস্থিতি ছাড়া ভালবাসার অস্তিত্ব অকল্পনীয় ও সব প্রেমের উৎস শরীরী আকর্ষণ। সফ্লোকিসের ইডিপাস রেক্স থেকে ফ্রয়েড সৃষ্টি করেন তার মতবাদ ইডিপাস কমপ্লেক্স। যেখানে মাতার প্রতি শিশু পুত্রের দৈহিক আসক্তি ও পিতার প্রতি শিশু পুত্রের ঈর্ষাবোধ দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে গ্রীসের পৌরাণিক লোক-কাহিনী, যেখানে, ইলেকট্রা নামে একজন নারী তাঁর এক ভাইয়ের সঙ্গে মিলে নিজের মাকে হত্যা করে পিতার সাথে বিয়ে করেছিল’ এটাকে কেন্দ্র করে ফ্রয়েড দাঁড় করান ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স। এখানে ফ্রয়েড দেখিয়েছেন কন্যা সন্তানের পিতার প্রতি থাকা এক ধরণের অবচেতন যৌন কামনা।
কালের প্রবাহে এই থিউরি বিতর্কিত এবং এর বিপক্ষে শক্ত যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ ফ্রয়েড যৌনতাকে আশ্রয় করে তত্ত্ব বানিয়েছিলেন, মস্তিষ্ককেই বাদ দিয়ে, মনকে বুঝতে চেষ্টা করে গেছেন ফ্রয়েড । কিন্তু এখনো এই মতবাদের প্রভাব কম নয়, এখনো অনেকের কাছে প্রেম মানেই শরীর বা যৌনতা।
জার্নাল অব সেক্স রিসার্চের গবেষকরা বলছেন, ভালবাসার সঙ্গে প্রতারণা করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়, ৭৭ ভাগ মানুষ ভালবাসা হারিয়ে অবৈধ সম্পর্কের সন্ধান করেন। অন্যদিকে ৪১ ভাগ চলমান সম্পর্কের ওপর বিশ্বাস রাখতে না পারায় অন্য সম্পর্কে ঝুঁকে পড়েন। ৪৩ ভাগ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভালবাসার অভিনয় করেন। অন্যদিকে প্রতারণা করা তিনজনের মধ্যে একজন শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কের জন্য ভালবাসার কথা বলে থাকেন। দেখা যায়, নারীরা প্রথম প্রেমের ক্ষেত্রে অবহেলা করে থাকেন, অন্যদিকে যৌন সম্পর্কের জন্য সঙ্গী খুঁজতে ভালবাসার অভিনয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ করেন।
পোল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী বাউমান বর্তমান ভালোবাসাকে ‘তরল ভালোবাসা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, শার্টের বুক পকেটে যেমন খুব বেশি দরকারী কোনো কিছু থাকে না এবং তা হারিয়ে গেলে খুব সহজেই সেটা পূরণ করা যায়, ভালবাসা তেমনই।