মোহাম্মদ নওশাদুল হক – খােলা বাজার২৪। রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১৮ : বৈশাখ-জৈষ্ট্য মাসের ভোর বেলা। হাওর পাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের ঘুম ভাঙ্গে কাঠ মিস্তিরির হাতুড়ির ঠাসঠাস শব্দে। বর্ষার আগমনী বার্তার জানান দেয় নৌকা মেরামতের ঐতিহাসিক আওয়াজ। চতুর্দিকে নৌকা মেরামত ও আলকাতরা লেপনের ধূম পড়ে যায়। সদ্য নৌকায় লাগানো আলকাতরার সাথে ঘষা খেয়ে কত নববধূ শ্বেতাঙ্গ হতে কৃষ্ঞাঙ্গ রূপ ধারন করে তার কোন ইয়ত্তা নেই। গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতে যখন হাওর-বিল নতুন পানিতে টুইটম্বুর যায়, তখন গ্রামের বধূকে কলসি কাধে পানি সংগ্রহ করতে আর বেশি দূর যেতে হয় না। ঘরের কোনেই পানি ঢেউ খেলে। তাইতো এক বাড়ি অন্য বাড়ী, পাড়া হতে পাড়া,গ্রাম হতে গ্রাম,বাড়ি হতে বাজার স্কুল মনজিদ সব ক্ষেত্রেই নৌকা ছাড়া বিকল্প কিছুই যেনো নেই আর। দু একটা কলার ভেলা চলতে দেখলেও, তা আর বলার মতো এমন কি! হাওর পাড়ের মানুষগুলোর বাৎসরিক খাবার জোগান দেয়া যেমনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ,তেমনি প্রত্যেক বাড়ীর জন্য কমপক্ষে করে নৌকা প্রস্তুত রাখাও উল্লেখযোগ্য কাজ। আর সেজন্যই প্রতিবছর গ্রীষ্মকাল এলেই ধুম পড়ে যেথো পানসী, বারকি, ডিঙা, গয়না, গোদারা, পাতাম আরও কত নামের নৌকা মেরামতের কাজ।
এতো বলছি আজ হতে পনের কুড়ি-বছর আগের কথা। এখন তেমনটি আর নেই। প্রতি বাড়িতে আর নৌকা প্রস্তুত রাখে না। এর অর্থ এই নয়, হাওরে এখন আর পানি আসে না। হাওরে পানি প্রতি বছরেই আসে। যে পানি প্রায় বছরই হাওর পাড়ের মানুষগুলোর দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নটাকেও দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত করে দেয়। তারপরও তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখে। এক বাড়ি আরেক বাড়ি,এক গ্রাম অন্য গ্রামে, বাড়ী হাটে বাজারে স্কুল কলেজ মসজিদে যায়। তবে নিজের নৌকায় নয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ফেরি নৌকায়। চলাচলের প্রয়োজনে বাড়ি ডাক দিলে কিংবা মোবাইল ফোনে কল করলেই ফেরি নৌকা ঘাটে চলে আসে। এবং দ্রুতই পৌছে দেয় কাঙ্খিত গন্তব্যে।
বৈশ্বিক ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে হাওর বাংলার নৌকা যোগাযোগেরও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বটে! হাওর বাংলায় মাঝির হস্তে চালিত সবকটি নৌকাই আজ ইঞ্জিনে চলে। তবে ধীরে ধীরে ঘটে যাওয়া এহেন উন্নয়নে সরকারী,বেসরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সরাসরি কোন উদ্যেগ ছিলো না নিশ্চয়ই! যাকে হাওর প্রযুক্তির উন্নয়নে নিরব বিপ্লব হিসাবে অভিহিত করা যায়। হস্তচালিত নৌকা এখন প্রায় বিরল। এ বিষয়টি বাংলাদেশের প্রযুক্তির উন্নয়নে নিরব বিপ্লব,যার সঠিক পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কোন সংস্থার কাছে আছে কি’না আমি জানি না। তবে আমি এতটুকু জানি, হস্তচালিত সবকটি নৌকা ইঞ্জিন নৌকায় পরিগণিত হওয়ায় গ্রাম্য সাধারণ মানুষের জীবনে ও যোগাযোগে ব্যাপক গতি এসেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
লেখক : প্রকৌশলী, গণপূর্ত বিভাগ।