Sun. Jun 15th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার ২৪,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০১৯ঃবাবার সঙ্গে নুসরাতের ‘কথোপকথন’

– বাবা, তুমি এখনো কাঁদছো যে…!
– কথা বলিস না মা। তুই কথা বললে আমার কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
– তোমার সঙ্গে কথা না বললে কথা বলব কার সঙ্গে? আমাকে সাহস দেবে কে? আমার হাত-পায়ের মেহেদীর রং ও কী পুড়ে গেছে বাবা? নবীজী মেহেদীর রঙ খুব পছন্দ করতেন, তাই না!
– তুই তো কথা শুনলি না। কত করে বললাম, চোখ বন্ধ করিসনে। চোখ খোলা রাখ মা, চোখ খোলা রাখ। তবু…..

– চোখ খোলা রাখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। পোড়া শরীরের কষ্টের চেয়ে চোখের কষ্ট যে আরও বেশি হচ্ছিল। আমি আর কিছু দেখতে চাইনি। ওরা প্রিন্সিপালের পক্ষে মিছিল করে। পুলিশ বলে- আমার গায়ে হাত দেওয়ার ঘটনা না কি সাজানো নাটক। চোখ খোলা রাখি কেমন করে!

– কেনরে মা? দেশের কত্তো মানুষ তোকে দেখার জন্য হাসপাতালে ভিড় করতে চাইছিল। কত মানুষ তোর জন্য দোয়া করছিল, চোখের পানি ফেলছিল। এগুলো তোর ভালো লাগছিল না?
– বাবা জানো? ডাক্তার চাচ্চুরাও অনেক কেঁদেছে। আমার শরীরে এটা ওটা কী সব লাগাচ্ছিল আর সবার চোখগুলো বারবার কেমন ভিজে উঠছিল।
– প্রধানমন্ত্রীও নিজে তোর খোঁজ খবর নিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে পাঠানোর কথা বলেছেন।

– তুমি প্রধানমন্ত্রীকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারবে বাবা? এখানে অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ করতে গেলেই আগুন ছুড়ে দেওয়া হয় কেন? ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয় কেন? আচ্ছা বাবা, দেশের যারা অনেক বড় বড় মানুষ তারা আমাকে নিয়ে তো খুব বেশি কথা বললেন না। চারদিকে এত মুখোশ কেন?
– জানি না মা।
– উফ্ …
– কী হলরে সোনাপাখি! এখনো খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি!

– মনে পড়ে বাবা, আমি যখন অনেক ছোট, একবার হারিকেন ধরাতে গিয়ে ম্যাচের কাঠিতে তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল একটুখানি পুড়ে গিয়েছিল। আঙ্গুলটা আমার গালের মধ্যে নিয়ে চেপে ধরেছিলাম, যাতে একটু আরাম লাগে তোমার। ভয়ে আমার সে কি কান্না! আমার অস্থিরতাকে ভুলিয়ে রাখতে তুমি বললে- ‘সামান্য এটুকুতেই যে কষ্ট, আগুনে পোড়া শরীরের কষ্ট মানুষ সহ্য করে কেমন করে!’ আমার শরীরের কত ভাগ পুড়েছিল বাবা?
– চুপ কর মা। আমি জানি না, জানতে চাই না….

– আমি তো হিজাব পরতাম। কুমিল্লার তনু আপুও হিজাব পরতো। প্রিন্সিপালকে ‘হুজুর’ বলে ডাকতাম। তারপরও ওরা আমাদের শরীরে হাত দেয়!
– তোর কোনো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেইরে লক্ষ্মী। জানিস, তোর জন্য হাজার হাজার মানুষ কাঁদছে! এত বড় জানাজা বড় বড় নেতা-মন্ত্রী-লেখকের জন্যও হয় না।

– সবাই কষ্ট পাচ্ছেন, জানি। কিন্তু আবার ভুলেও যাবে। আমার মতো কত নুসরাত চলে গেল। তবে আমাকে আগুনে পুড়িয়ে ওরা কিন্তু ভালোই করেছে। না হলে তো আমার গায়ে হাত দেওয়ার কথা এমন করে সবাই জানত না, পত্রিকায় এত বেশি করে লেখা হতো না। তুমি তো দেখি আবার কাঁদছো। কাছে তো যেতে পারছি না বাবা। চোখ মুছে দেব কী করে?

– তোকে কিছু করতে হবে না। আমরা কেউই তো কিছু করতে পারলাম না তোর জন্য।
– গলা শুকিয়ে আসছে। এখন কি একটু পানি দেবে বাবা? এখন পানি দিলে তো ডাক্তার কিছু বলবে না।
– পানির দিকে তাকালে কেমন যেন করে মাগো! এখন আর সহজে পানি খেতে মন চায় না।
– বাবা, আরেকটা কথা বলি? তোমাকে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ডাকবেন। সান্ত্বনা দেবেন। হয় তো কিছু উপহারও দেবেন। প্রিন্সিপালের শাস্তির আশ্বাস দেবেন। একটা প্রশ্ন কি তাকে করতে পারবে?
– বলে যা মা। তুই যা বলবি, সব করব, সব….।

– উনাকে বলো- সরকারে থাকা দলগুলোর মানুষরা কি সবসময় অপরাধীর পক্ষ নেবে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তোমাকে-ভাইয়াকে যারা হুমকি দিচ্ছিল তারা তো প্রধানমন্ত্রীর দলই করতেন। এটা কি প্রধানমন্ত্রী জানেন?
– সব দোষ আমার। আমি তোকে মামলা না করতে দিলেই ভালো হতো।

– সেটা তুমি পারতে না, মা-ই পারল না। বাবা, মাকেও কি ওরা পুড়িয়ে মারবে? আমার শরীরে হাত দেওয়ার ঘটনায় মা-ইতো মামলা করেছিল। মা কি জানে- আমি মারা গেছি? মা নাকি একেবারে চুপ হয়ে আছে? মায়ের গলাটা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে। না থাক্, ডেকো না। মা’র কান্না সহ্য করতে পারব না।

– মাগো! আর কথা বলিস না। আমি কী করবরে লক্ষ্মীসোনা, কী করে থাকব….
– আমি ভালো আছি বাবা। এই যে আমি এখন আকাশে উড়ছি। পোড়া ওড়নাটা মেঘ হয়ে ভাসছে। শুধু খারাপ লাগছে অন্য কোনো নুসরাতের বাবার কথা ভেবে, মায়ের কথা ভেবে। নুসরাতরা তো মরে বেঁচেই যায়!