খােলাবাজার২৪, শুক্রবার, ১২ র্মাচ ২০২১ঃ নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাই ছিল আদি বাহন। এ দেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল, বিল, হাওর-বাওর। আবহমান কাল থেকে এই জলধারায় বিভিন্ন ধরনের নৌকা বয়ে চলছে। কিন্তু দিনে দিনে এসব নদ-নদী, খাল-বিল হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। সেই সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে নানা রকমের নৌকাও। পাল তোলা সারি সারি নৌকার নৈসর্গিক দৃশ্য যেনো আজ স্বপ্নের মত। এখন পাল তোলা নৌকার দেখা মিলে না। নদীতে সারি সারি পাল তোলা নৌকার সেই মনোরম, মনোহর ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। আগে গ্রামাঞ্চলের ঘাটে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকতো। এখন যান্ত্রিক স্পিডবোট তার স্থান দখল করে নিয়েছে। এখনও নদীমাতৃক আমাদের জীবন-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। কিন্তু পানি শূন্যতা আমাদের সবকিছু পানসে করে দিচ্ছে। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। যান্ত্রিক যানবাহন হটিয়ে দিচ্ছে জীবন নির্ভর যানবাহনকে। শেকড় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে জীবন। নদী আর নৌকা ছিল বাঙালির গ্রাম্য জীবনের বহমানতা। সভ্যতার পালে লেগেছে হাওয়া, ছুটছে মানুষ দ্রুত। কোথায় যাচ্ছে এবং কেন যাচ্ছে তা কারো জানা নেই। নৌকা নিয়ে অনেক গানও রচিত হয়েছে। যেমন-‘পাল তোলা ওই নায়ের মাঝি/ ভাটিয়ালি গায়/ ঘোমটা পরা গায়ের বধূ/ শশুরবাড়ি যায়। ও মাঝি ভাই ও মাঝি ভাই/ কোন সে গাঁয়ে যাও/রূপগঞ্জে মামার বাড়ি আমায় নিয়ে যাও/আষাঢ় মাসে ভাসা পানি/পুবালী বাতাসে বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/আমারনি কেউ আসে/’। মাঝিকে গাঁয়ের বধুর এমন আকুতিও হারিয়ে গেছে। আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে যান্ত্রিক যানবাহনের ভারে পাল তোলা নৌকা আজ স্মৃতির অতলান্তের পথে। বর্ষাকাল এলে এখন নদীতে যেটুকু সময়ে পানি থাকে, বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তখন কিছু নৌকা দেখা যায়। হাতেগোনা দু’একটা চোখে পরলেও তাদের নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নতুন বধূ বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য পাল তোলা নৌকার বায়না ধরে না। নৌকার ইতিকথা প্রাচীন বাংলার অন্যতম কেন্দ্র চন্দ্রকেতু গড়ের কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। এই চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া বেশ কিছু পোড়ামাটির সীলে নৌকার উল্লেখ আছে। আবার দুটো নৌকার নামও পাওয়া গেছে সেখানে। একটা হলো ‘এপ্য’ বা এপ্পগ অন্যটা ‘জলধিসক্ল’ (জলধিশত্রু)। জলধিশত্রুটা ছিল সম্ভবত যুদ্ধ জাহাজ। খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকের পেরি প্লাসের বিবরণীতেও এপ্পগ নামের জলযানের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। মনসা মঙ্গল ও চন্ডী মঙ্গলেও বাংলা অঞ্চলে নদীপথ ও সমুদ্রপথে চলাচলে উপযোগী দাড়-টানা পণ্যবাহী জলযান নৌকা বা ডিঙ্গার কথা আমরা একাধিক বার খুঁজে পাই। কবি মুকুন্দ রায় আর চন্ডীমঙ্গলে ‘জঙ্গ’ নামের এক ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজের কথা লিখেছিলেন। এখনও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জামালপুর এলাকায় ‘ঝঙ্গ’ নামের এক ধরনের নৌকা দেখা যায়, যা সম্ভবত সেই প্রাচীন জঙ্গেরই উত্তরসূরি। পনের শতকের শেষের দিকের কবি বিপ্রদাস পিপলয়, মুকুন্দরায়ের বর্ণনায় বর্ণাঢ্য নাম আর বিবরণে সব নৌকা উঠে এসেছে মাঝে মাঝে। কি দারুণ সব নাম ছিল- নরেশ্বর, সর্বজয়া, সুমঙ্গল, নবরত্ন, চিত্ররেখা, শশিমঙ্গল, মধুকর, দূর্গাবর, গুয়ারেখি, শঙ্খচূড় আরও অনেক কিছু! সে সময়ে নৌকা বানানো হতো কাঁঠাল, পিয়াল, তাল, শাল, গাম্ভারি, তমাল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে। মুসলমান…