চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নির্দেশেই তাঁর বাড়ির পাশে অবৈধভাবে কেন্দ্র বানিয়ে করোনার গণটিকাদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল। হুইপ নিজে উপস্থিত থেকে এই টিকা কার্যক্রম শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত না মেনে ইচ্ছামাফিক তাঁর এই গণটিকাদান কাণ্ড নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও বিব্রত ও ক্ষুব্ধ।
অনেকে মনে করছেন, হুইপ হয়েও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নের রশিদাবাদে নিজের গ্রামের বাড়ির মাত্র কয়েক শ গজের মধ্যে অবৈধভাবে কেন্দ্র বানিয়ে এই টিকাদান নিয়ে হুইপ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, দেশে সরকার নির্ধারিত কেন্দ্রের বাইরে কোথাও টিকা দেওয়ার নজির নেই। ইউনিয়ন পর্যায়ে সারা দেশে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে আগামী ৭ আগস্ট। তার আট দিন আগেই পটিয়ার রশিদাবাদ এলাকায় হুইপের বাড়িসংলগ্ন স্কুল ও কলেজে অবৈধভাবে টিকাদান শুরুর ঘটনাটি পুরো টিকাদান কার্যক্রমকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে টিকা দেওয়া শুরু হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। হুইপের বাড়ির পাশে অবৈধভাবে এই টিকাদানের ঘটনায় দেশে একটি বাজে নজির সৃষ্টি হয়েছে। হুইপ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশের করোনা ভ্যাকসিন টিকাদান কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না। তিনি কিছুতেই এই দায় এড়াতে পারেন না।
গতকাল রবিবার ‘হুইপ সামশুলের বাড়ির পাশে অবৈধ টিকাদান কেন্দ্র!’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। হুইপের বাড়ির পাশে অবৈধভাবে কেন্দ্র বানিয়ে করোনার টিকা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে আরো কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় চলছে দুই দিন ধরে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও বিষয়টি মনিটর করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে টিকা দেওয়ার দুই দিন পর অবশেষে গতকাল থেকে হুইপের গ্রামের বাড়ির পাশের ওই দুই অবৈধ কেন্দ্রে টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের গঠন করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সকাল থেকে পটিয়ায় গিয়ে দিনভর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। তদন্তে হুইপের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও উঠে আসছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রে জানা যায়, ওই টিকাদানের সঙ্গে জড়িত প্রধান অভিযুক্ত পটিয়া স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) মো. রবিউল হোসেন তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন, হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নির্দেশে এই টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল।
সরকারি দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হুইপের নির্দেশনা ছাড়া এই কাজ হওয়াটা অসম্ভব। তাঁর নির্দেশনা না থাকলে বাড়ির পাশে কিভাবে এই কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি নিজেও সেখানে গিয়ে গত শুক্রবার টিকাদান কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। সামশুল হক চৌধুরীর সম্মতি ও নির্দেশনার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এরই মধ্যে স্বীকারও করেছেন মো. রবিউল হোসেন।
এদিকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ গতকাল মো. রবিউল হোসেনকে শোকজ করেছেন। রবিউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, টিকাদান কার্যক্রমে তিনি অনেকের কাছ থেকেই ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। আড়াই থেকে তিন হাজার জনকে টিকা দেওয়ার কথা আলোচনায় এলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, দুই হাজার ৬০০ ডোজ টিকা সেখানে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, টিকা প্রদান নিয়ে বাণিজ্যও হয়েছে। টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে। এর সঙ্গে রবিউলসহ আরো আট থেকে ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট জড়িত। আর এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সবাই সামশুল হক চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর ২০১২ সালে রবিউলের এই সরকারি চাকরি সামশুল হক চৌধুরীর সুপারিশেই হয়েছে—এমনটা সবার মুখে মুখে ফিরছে।
অবৈধভাবে টিকাদান কেন্দ্র চালুর এই ঘটনা তদন্তে এর আগে গত শনিবার চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারির সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অজয় দাশ। কমিটির সদস্যসচিব চট্টগ্রাম জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান ও সদস্য একই কার্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মো. নুরুল হায়দার। এই কমিটি গতকাল নগর থেকে পটিয়ায় গিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
তদন্ত কমিটি গঠন সম্পর্কিত বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘গত ২৭ জানুয়ারি ২০২১ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক কভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি উদ্বোধন করার পর ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সারা দেশে একযোগে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম শুরু হয়ে এখনো চলমান আছে। কভিড-১৯ ভ্যাকসিন উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য সরকারিভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে কভিড-১৯ (সিনোফার্ম) টিকা প্রদান করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায় থেকে কোনো ধরনের অনুমতি না নিয়ে চট্টগ্রাম জেলাধীন পটিয়া উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উক্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) মো. রবিউল হোসেন কর্তৃক গত ৩০ ও ৩১ জুলাই কভিড-১৯ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন অন্যত্র নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশনবিহীন লোকদের প্রদান করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির গতকাল বিকেলে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আজ ঘটনাস্থলে গেছে। তদন্ত সম্পর্কিত কোনো তথ্য এখনো পাইনি। যাদের মাধ্যমে এই টিকা প্রদান করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ভ্যাকসিন প্রদানসংক্রান্ত জাতীয় কমিটিকে আমরা লিখিতভাবে জানাব। সরকার আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার আগেই পটিয়ার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে যে টিকা দেওয়া হয়েছে, তা তারা করতে পারে না। সরকার নির্ধারিত কেন্দ্রের বাইরে করোনার টিকা প্রদানের সুযোগ নেই।’ একই বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘সেখানে টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ বলেন, ‘মো. রবিউল হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। এর সঙ্গে আরো কারা জড়িত তা খুঁজে বের করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি এখন আমার কার্যালয়ে আছে। তারা পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে। এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় টিকা দিলেও সেখানে আমি কিংবা সিভিল সার্জন কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো অনুমতি ছিল না।’
তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের অর্থো সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অজয় দাস বলেন, ‘ঘটনাটি অনেক বড়। আজকে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। যারা টিকাদানে জড়িত ছিল তাদের পাশাপাশি যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলছি। রেজিস্ট্রেশন কার্ড থাকলে তা প্রকৃত না ভুয়া তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ভ্যাকসিনগুলো যথাযথভাবে (তাপমাত্রা মেনে) সংরক্ষণ করা হয়েছিল কি না তা-ও খতিয়ে দেখছি।’
টিকা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কোনো অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মতামত থাকবে। এখানে একাধিক বিষয় জড়িয়ে গেছে। তাই পুরো তদন্ত শেষ করতে আরো সময় লাগতে পারে। আমরা সময় চাইব।’
ঝুঁকি নিয়ে প্রায় তিন হাজার টিকাদান : চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে দেশে করোনার গণটিকা কার্যক্রম শুরুর পর বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন, নির্ধারিত কেন্দ্রে টিকাদান, চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা, আবশ্যিকভাবে এইএফআই কিট রাখা, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও অ্যাম্বুল্যান্স প্রস্তুত রাখা, টিকা গ্রহণের পর গ্রহীতাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখার ব্যবস্থাসহ আরো কিছু নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু পটিয়ার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে বিভিন্ন বয়সী প্রায় তিন হাজার লোককে সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হলেও সরকারি এসব নির্দেশনার কোনোটাই মানা হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের এসব সাধারণ মানুষ টিকা নিয়েছেন।
সরকারি দলের মতাদর্শী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও করোনার চিকিৎসাসেবায় সমন্বয়কারী ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান গতকাল বলেন, ‘শুনেছি, পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সংশ্লিষ্ট কাউকে না জানিয়ে রশিদাবাদে হাজারো মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যাঁদের টিকা দেওয়া হয়েছে সে টিকাগুলো উপজেলা থেকে ওই এলাকায় নেওয়ার পর কত সময় রাখা হয়েছিল। তাপমাত্র ঠিক ছিল কি না? তদন্ত কমিটির এসব বিষয়ও দেখা উচিত।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকার মজুদে ঘাটতি, নতুন করে জেলা থেকে সরবরাহ : গত শুক্রবার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নের আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরদিন শোভনদণ্ডী স্কুল অ্যান্ড কলেজে কেন্দ্র বানিয়ে করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। দুই দিনে আড়াই থেকে তিন হাজার ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এসব টিকা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এতে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিয়মিত টিকা কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় গত শনিবার চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে আবার টিকা নিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কর্মকর্তারা জানান, শোভনদণ্ডীতে টিকা নিয়ে যাওয়ায় মজুদ সংকট ছিল। এ কারণে আবার জেলা থেকে টিকা আনা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, গত শুক্রবার টিকা কার্যক্রম শুরুর আগে এলাকায় বিভিন্ন পয়েন্ট এবং যেখানে টিকা দেওয়া হয়, সেখানে ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে প্রচার চালানো হয়। এসব প্রচারপত্রে লেখা ছিল—হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির একান্ত প্রচেষ্টায় শোভনদণ্ডী ইউনিয়নবাসীকে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি। শুভ উদ্বোধন শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা (১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড); স্থান : রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়। শনিবার সকাল ৯টা থেকে ১টা (৪, ৫, ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড); স্থান : শোভনদণ্ডী স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ব্যবস্থাপনায় : শোভনদণ্ডী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ।