Tue. Oct 28th, 2025
Advertisements


সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জ জেলার একমাত্র বালুমিশ্রিত পাথর কোয়ারি ধোপাজান। পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার মামলায় ২০১৮ সাল থেকে আদালতের আদেশে এই কোয়ারিতে বন্ধ হয় বালু উত্তোলন। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট নদীতে মব কায়দায় বালু লুট শুরু হলে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়। এদিকে, পরিবেশ বিধ্বংসী ড্রেজারের ধ্বংসলীলা থেকে প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় বালু উত্তোলন বন্ধের যে আদেশ দিয়েছিলেন আদালত, সেই না মেনে অবৈধ ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে শত কোটি টাকার বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে বিআইডাব্লিউটিএ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ২১ লাখ ঘনফুট মাটিমিশ্রিত বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। অনুমতি পেয়েই নদীর একাধিক স্থান থেকে অসংখ্য পরিবেশ বিধ্বংসী ড্রেজার ও বোমা মেশিনের তান্ডব চালাচ্ছে লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং। আদালতের আদেশে ধোপাজান-চলতি নদীর কোয়ারি বন্ধ থাকলেও ভিন্ন কৌশলে নদী থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বালু। উন্নয়ন প্রকল্পে মাটিমিশ্রিত বালু দেয়ার নামে উত্তোলন করা হচ্ছে সিলিকা বালু। অবৈধ পন্থায় সিলিকা বালু বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।সরেজমিনে সুনামগঞ্জ সদর-বিশ্বম্ভরপুর এলাকার ধোপাজান-চলতি নদী ঘুরে দেখা যায়, দিনে ও রাতে নদীর একাধিক স্থানে ড্রেজার ও বোমা মেশিন বসিয়ে বাল্কহেড নৌকায় উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। দিনে লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং উত্তোলন করলেও, রাতের বেলা লিমপিডের নাম ভাঙিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র উত্তোলন করছে এসব বালু। অপরদিকে, এসব বালুবোজাই বাল্কহেড থেকে ১৮-২০ টাকা রয়েলেটি আদায় করছে বিআইডাব্লিউটিএ। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে নৌপথে বাল্কহেড বোঝাই এসব বালু সুরমা নদীতে এনে বিভিন্ন ডা¤িপং পয়েন্টের ব্যবসায়ীদের কাছে স¤পূর্ণ অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। সুরমা নদী তীরের বিভিন্ন বালু ডা¤িপং পয়েন্টে বালু বিক্রির একাধিক রশিদ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। যেখানে দেখা যায়, লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নাম ও সিল ব্যবহার করে বালুর পরিমাণ লিখে ক্রয় রশিদ দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক বালু ব্যবসায়ী বলেন, আমরা প্রতিদিনই লিমপিড কো¤পানির লোকদের কাছ থেকে বালু কিনছি। তারা আমাদের রশীদ দিচ্ছেন। প্রতিদিন ৮০-১০০টি নৌকায় করে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। নিজের কাছে থাকা একাধিক ক্রয় রশীদ বের করে দেখালেন এই ব্যবসায়ী।বালু বিক্রির বিষয়ে বিআইডাব্লিউটিএ-এর সিলেট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শরীফুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে উত্তর দিতে রাজি হননি। এদিকে নদীতে অসংখ্য দানবীয় মেশিনে বালু তোলায় নদীগর্ভে বিলীনের শঙ্কায় ধোপাজান-চলতি নদী তীরবর্তী অন্তত ১৫টি গ্রামের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, ফসলরক্ষা বাঁধ, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বস্তা বাঁশ দিয়ে বসতঘর টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ বালুর বাইরে কোটি কোটি টাকার বালু লুট করা হচ্ছে। বালু লুট ও নদী ভাঙন ঠেকাতে মানববন্ধন করছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিবেশকর্মীরা। নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে বারকি শ্রমিক নেতা মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, নদী বন্ধ থাকায় আমাদের বারকি শ্রমিকরা দিনের পর দিন বেকার অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। অথচ একটি কাগজের বলে লিমপিড কো¤পানি এই নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু নিয়ে যাচ্ছে। কো¤পানিকে ভিট বালির অনুমতি দিলেও তারা নদী থেকে সিলিকা বালু উত্তোলন করছে। আমরা আমাদের নদীতে ড্রেজার চালাতে দিবো না। যদি কো¤পানিকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয় তবে বারকি শ্রমিকদেরও দিতে হবে। পরিবেশকর্মী ওবায়দুল মিলন বলেন, লিমপিড একটি কাগজের উপরে ভিত্তি করে ধোপাজানের বালু লুট করছে। এই লুটের সাথে একটি চক্র জড়িত রয়েছে। যারা রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে এমন কাজ করছেন। আমরা দাবি করছি দ্রুতই এই বালি লুট বন্ধে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নতুবা সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে। স্থানীয়দের পরামর্শ ছাড়া সরকারি একটি সংস্থা প্রকৃতি এবং পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্ত দেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ধোপাজান-চলতি নদীতে বালু উত্তোলনে অনুমতির সুযোগ নেই। এলাকাবাসীও চাননা এখানে বালি উত্তোলন হোক। বালু উত্তোলন বন্ধ করতে আমরা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি লিখেছি। এদিকে, পরিবেশগত সংকটাপন্ন নদী থেকে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই জানিয়েছে বেলা। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানালেও কোন নির্দেশনা পায়নি জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মাদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ধোপাজান পাথর মিশ্রিত বালু মহালটি জ্বালানী ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন। লিমপিড যখন বালু উত্তোলন করছিলো তখন আমরা সেটি বন্ধ করে দিয়েছিলাম এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি লিখে এর কারণও জানিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তী লিমপিড অনুমতিপত্র নিয়ে আসে, আমরা বাধা দিতে পারছি না। তবে বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন বিভাগ অবহিত বলে জানান তিনি।