Sun. May 4th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

॥ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
27‘পরিচিত রাজনীতির গণ্ডিটা মুছে ফেলতে না পারলে বাংলাদেশে দুর্নীতি কমবে না’, কথাটা একজন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো অধ্যাপকের, ঢাকার এক আড্ডায়। তার মতে স্বাধীনতার আগে বা পরে, বাংলাদেশের দুর্নীতির রূপটা এমন যে, বেশিরভাগ মানুষের মনে ভাবনা তৈরি করে, সৎভাবে ভালো থাকা যায় না।
তো সেই দেশের মানুষ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা কেলেঙ্কারির মতো বড় মাপের দুর্নীতি আগে দেখেনি, এমনটা নয়। প্রতাপশালী রাজনীতিক, প্রভাবশালী আমলা আর মহাকোটিপতি ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র আমাদের চেনা। তদন্ত চলাকালীন অভিযুক্ত বা সাক্ষী খুন? তা-ও বহুবার দেখেছে বাংলাদেশ। তাহলে কেন আমরা এতটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি? কারণ হলো এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের উ”চপদস্থ কর্মকর্তা, নাম শোনা যাচ্ছে আরও বিদ্বতজনদেরও, আর পেশাটি যে ডাক্তারি!
পাবলিক পরীক্ষা, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা মানেই এখন কেলেঙ্কারি, প্রশ্নপত্র ফাঁস। সর্বশেষ সংযোজন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দুর্নীতির এক জটিল আবর্ত। বোঝাই যাচ্ছে এ কেলেঙ্কারি স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে, কারণ কর্তৃপক্ষ সনদ দিয়েছেন, পরীক্ষা ভাল হয়েছে। আমরা বলতেই পারি, এ আর নতুন কী! দেশটার নাম যখন বাংলাদেশ, এমন ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার মতো কী হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় সম্ভব নয়। আসলে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা কেলেঙ্কারি এমন একটি ঘটনা, যেখানে আমরাই আমাদের তুলনা। দুনিয়ার আর কোথাও হয়তো আর পাওয়া যাবে না।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা মানেই দরিদ্র মেধাবী, কিংবা যারা স্বাভাবিকভাবে সবকিছু মোকাবেলা করতে চায় তাদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। প্রতিটা পরীক্ষার পর এরা ট্রমায় নিপতিত হয়, কারণ এরা সৎভাবে সবকিছু করতে চায়, এরা পরিশ্রম করেই ভাল ফলাফল অর্জন করতে চায়, কিন্তু দুর্নীতির দুষ্টচক্র এদের স্বপ্ন কেড়ে নেয় বারবার। এ যাবৎকাল ক্ষমতার যত রকম অপব্যবহার দেখেছি, সরকারি চাকরিতে, উ”চশিক্ষার ক্ষেত্রে ঘুষ নিয়ে ভর্তির যত উদাহরণ দেখেছে, এই কেলেঙ্কারি তার থেকে আলাদা, মারাত্মক, শিরদাঁড়া দিয়ে আরও ঠা-া স্রোত বইয়ে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর। কারণ যারা এভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে টিকে গেল, তারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলবে নিকট ভবিষ্যতে।
এই কেলেঙ্কারির ধরনটাও আলাদা। এই দুর্নীতি অনেক বিস্তৃত, অনেক গভীর। তাই যে মানুষ এদেশের সবসময়ের দুর্নীতি নিয়ে অতিবিরক্ত, পোড়-খাওয়া, তারাও আজ চমকে গেছে। তবে এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন হাইকোর্টে খারিজ হয়ে যাওয়ায় হয়তো উ”চবাচ্য কমতে শুরু করবে। ফল প্রকাশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে করা রিট নাকচ হলেও জনমনে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে যে প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে, সেটি কোনওদিনই মুছে যাবে না। ফল বাতিলের দাবিতে পরীক্ষার্থীদের একাংশ এখন রাস্তায়, তাদের অভিভাকরা রাস্তায়।
বর্তমানে সময়েই দেশের হাসপাতাল, চিকিৎসক, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে তীব্র জনঅসন্তোষ আছে। যে ধারার প্রর্বতন হলো, তাতে বলা যায় একদিন চিকিৎসা নিতে গিয়ে হয়তো হাসপাতাল গণমৃত্যু হবে মানুষের, কারণ তখন চিকিৎসক থাকবেন এই শ্রেণিভুক্ত ডাক্তাররা, যারা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য, এবং সরকারি চাকুরি পাওয়ার জন্য দালালদের হাতে মোটা মোটা টাকা তুলে দিয়েছিলেন।
ইউজিসি’র এক কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন আটক হয়েছেন। মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় র‌্যাবের অভিযানে যারা আটক হয়েছে তাদের কাছে পাওয়া যায় ১ কোটি ২১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন ব্যাংকের চেক, নগদ টাকা ও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন-উত্তরপত্র এবং ভর্তি পরীক্ষার নিবন্ধনপত্র। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, এ চক্রের প্রধান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়াকে ২০১১ সালে একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ আছে, জসিমের নিকটাত্মীয় অধিদফতরের ছাপাখানার এক কর্মী। ওই কর্মীকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে দুবার ছাপাখানা থেকে বদলি করে দেওয়া হয়। প্রভাব খাটিয়ে তিনি আবারও ফিরে আসেন ছাপাখানায়।
ডাক্তারির মতো পেশায় যদি যোগ্যতার বদলে ঘুষ দিয়ে প্রবেশ করা যায়, তবে সেই ডাক্তারদের হাতে যাদের জীবনের ভার, সেই সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের কী হবে, এ প্রশ্ন তো আছেই। কিন্তু প্রশ্ন অন্য পিঠেও আছে, যারা ঘুষ না দিয়ে, নিজেদের যোগ্যতার জোরেই ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়েছেন, তাদের মানুষ আলাদা করে চিনবেন কী করে? ঘুষের ডাক্তারদের জন্য কি তারাও নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন?
সত্যিই তাই। হারাবেন। মানুষ আর আলাদা করতে পারছে না, পারবে না। বিশ্বাসের জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এই পেশার ভাবমূর্তিতে জোরালো ধাক্কা লাগল এর মাধ্যমে। তদন্ত তদন্ত খেলা চলবে ক’দিন, তারপর আবার আমরা ভুলে যাব। প্রতিবছরই মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা বিতর্ক ওঠে। এবার কেলেঙ্কারি হলো। শুধু আশাই করবো প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক। আর শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করতে পারি, তাদের অভিভাবকদের অনুরোধ করতে পারি অর্থ দিয়ে কিনতে যাবেন না এমনসব প্রশ্নপত্র।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন