॥ তুষার আবদুল্লাহ ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ১২ অক্টোবর ২০১৫ : গল্প নয় সত্যি—এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়েছে যতটা, তারচেয়ে বিতরণ হয়েছে বেশি। হাটে-মাঠে-ঘাটে বিলি হয়নি, হয়েছে পরিবার ও বন্ধুজনের মাঝে। গল্প আকারে যারা তথ্য দিয়েছেন, তাদের তথ্য মতে, যিনি প্রশ্ন ফাঁসের নাটের গুরু, তিনি একটি বিভাগীয় শহরের মেডিক্যাল কলেজে ছিলেন একদা। এখন রাজধানীতে আছেন একটি অধিদফতরের শীর্ষ পদে। বিভাগীয় শহরে থাকার সময় তার বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। পাওয়া গিয়েছিল প্রমাণও।
এবার তার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ডাল-পালাও যোগ দিয়েছিল। সঙ্গী হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কতিপয় কুশীলব। তাদের আগে থেকেই নানা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ বিষয়ে সুদূর চীন থেকে প্রযুক্তি আমদানি করেও নিয়ে এসেছিলেন তারা। আর নেপথ্যের মাফিয়া হিসেবে তো কোচিং সেন্টারগুলো রয়েছেই। গত কয়েক বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আয়োজনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মালিক-পরিচালকরাও। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা যেখানে পৌঁছেছে, তাতে শিক্ষার্থী পেতে অনৈতিক কৌশলই এখন ভরসা!
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি—স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য দিলেও, তিনি বক্তব্য শেষে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেননি। কারণ যদি সত্যিই প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়ে থাকে, তাহলে ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজতে র্যাব-পুলিশের অভিযান কেন? ইউজিসির কর্মকর্তা আটক হলেন, জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ায় তার মৃত্যুও হলো। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন ভর্তিবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা, তারা প্রথমে একা ছিলেন। তাদের দাবি ছিল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের। কারণ টাকা ও আত্মীয়-বন্ধুত্বের সূত্রে যারা প্রশ্ন পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেলো, তারা চিকিৎসক হওয়ার মানসম্মত শিক্ষার্থী নন। আর অনৈতিকভাবে ভর্তি হতে পারেন যারা, তারা পাস করে বের হওয়ার সময়ও একই পš’া অবলম্বন করতে পারেন। ফলে চিকিৎসা শিক্ষার মান নেমে যাবে। কমবে চিকিৎসকেরও মান। যা গোটা স্বাস্থ্যখাতকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দেশের চিকিৎসকদের ওপর কমে যাবে রোগীদের আস্থা। দেশে মেধাহীন চিকিৎসক শ্রেণি তৈরি হবে। এই আশঙ্কা থেকেই আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানানোর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। চিকিৎসকরাও যুক্ত হচ্ছেন এর সঙ্গে। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা নয় কেবল, সিনিয়র চিকিৎসকরাও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। যতটা প্রকাশ্য সমর্থন আশা করা যাচ্ছিল, ততটা আসছে না এই জন্য, আগামী ১৩ নভেম্বর এই পেশাজীবীদের নির্বাচন রয়েছে। নির্বাচনের আগে কেউ বিব্রত হতে চাচ্ছেন না।
তবে প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদ ও পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সবার একজোট হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, ২০২২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে সনদপ্রাপ্তরা দেশের বাইরে কাজ পাবেন না। কারণ কাজ পাওয়ার মতো মানের চিকিৎসক বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না। তিনবছর আগে মেডিক্যালে ভর্তির জন্য ন্যূনতম নম্বর যখন ১২০-এ নামিয়ে আনা হয়েছিল, তখন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমন অনেকে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল যারা, এ বিষয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখে না। তিন বছরে এসে এর প্রমাণও মিলেছে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ভর্তির ন্যূনতম নম্বর ১৪০-এ আনা হয়েছে, কিন্তু তারপরও যে প্রক্রিয়ায় ভর্তি ও পাস করানো হচ্ছে, তাতে মানসম্মত চিকিৎসক আগামীতে পাওয়া যাবে না। অদূর ভবিষ্যতে ওষুধ খাতে এবং চিকিৎসা শিক্ষা খাতে ভর্তুকি বন্ধ হয়ে যাবে। এই খাত পুরোটাই বাণিজ্যিক খাতে পরিণত হবে। তখন মেধাহীন, অদক্ষ চিকিৎসকের বাইরে যেমন বাজার থাকবে না, ভেতরেও তাদের কদর থাকবে না। চিকিৎসার জন্য বাইরের চিকিৎসকদের ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকবে। অন্যান্য করপোরেট সংস্থার মতো, এরই মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে বিদেশি চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীতে তারা জেলা-উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়তে পারেন।
যাদের কাছে এই সত্য গল্প শুনছিলাম, তাদের কাছেই প্রশ্ন রাখা-আচ্ছা রাষ্ট্র কি এই তথ্যগুলো জানে না। এর পেছনে যে বাণিজ্যিক ও বেনিয়া ষড়যন্ত্র আছে, রাষ্ট্র সেই বিষয়ে অবগত নয়? উত্তরে গল্পের কথকেরা জানালেন, কড়ি দিয়ে রাষ্ট্রের বিবেক কেনা হয়ে গেছে। এখন আগামী প্রজন্মের চিকিৎসকরা অসার হলেও তারা নির্বাকই থাকবেন। কেননা কড়ির ডোজের পরিমাণ মন্দ নয়! বাংলাট্রিবিউন
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি