॥ ইসহাক খান ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫ : দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশ শান্ত। বিরোধী দলের কঠিন কর্মসূচি নেই। জ্বালাও-পোড়াও নেই। গাড়ি ভাঙচুর নেই। তারপরও দেশ নানা কারণে অশান্ত। এর জন্য বিরোধী দল যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী সরকারি দল আওয়ামী লীগ।
যদিও আকস্মিকভাবে দেশকে জঙ্গি বানানোর একটা অপকৌশল লক্ষ করা গেল, এটা যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। খোলা চোখেই খেলাটা বোঝা গেল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে জামায়াত-বিএনপি লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। তাদের কাজ হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা। বড় বড় মিডিয়া ভাড়া করে বাংলাদেশবিরোধী নেতিবাচক খবর প্রচার। যে মুহূর্তে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষিত হলো এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রইল, ঠিক তার আগে-আগে জামায়াত-বিএনপির লবিস্টরা নড়েচড়ে বসল। তারা আইএসের নামে ইন্টারনেটে ফেক আইডি থেকে প্রচার শুরু করল, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হবে। গল্পটা দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল।
আইএসের ঘোষণার পরপরই নিরীহ এক ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যা করা হলো। তার চার দিন পর জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যা করা হলো প্রায় একই কায়দায়। ঈশ্বরদীতে একজন যাজককে হত্যার চেষ্টা করা হলো। এসব ওপরওয়ালাদের নিজস্ব খেলা। গরম তাওয়ায় রুটি সেঁকলো অস্ট্রেলিয়া। তারা জঙ্গি হামলার অজুহাতে তাদের ক্রিকেট টিমকে বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করল। ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশ জঙ্গি দিয়ে ভরে গেছে। ওখানে গেলেই নাই হয়ে যেতে হবে।
অথচ এরকম হত্যাকাণ্ড সারা বিশ্বেই হরহামেশা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া যখন আমাদের জঙ্গি বলে নাক সিটকাচ্ছিল ঠিক তখনই তাদের পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে দুজনকে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটেছে আমেরিকার ওরেগনের এক কমিউনিটি কলেজে। একজন বন্দুকধারী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১০ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করেছে। এ বছরই আমেরিকায় ৪৫টি স্কুলে হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছে শতাধিক, আহত হয়েছে অসংখ্য। তাতে কি, আমেরিকা যাওয়া বন্ধ করেছে বিশ্ববাসী?
বাংলাদেশের ব্যাপারে পশ্চিমাদের আগ্রহটা একটু বাড়াবাড়ি ধরনের। তারা লবিস্টদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রের তকমা পরাতে ভীষণ ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু জ্ঞানপাপী লোকের প্ররোচনাও কম দায়ী নয়। তাদের আন্তর্জাতিক মানের পরিচিতি আছে। তারা সেই পরিচয় ভাঙ্গিয়ে সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানাতে। ঘোষিত হওয়া দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর আপিলের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এ জাতীয় ঘটনা আরো ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমাদের প্রশ্ন দেশবাসীর হালহকিকত প্রসঙ্গে। তারা কেমন আছেন? যদি বলি তারা ভালো নেই তাহলে কি মিথ্যে বলা হবে? এই ভালো না থাকার কারণ কি? দেশে তো হরতাল-অবরোধ নেই। বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন নেই। তাহলে দেশের মানুষ ভালো নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাব আওয়ামী লীগের নেতারাই ভালো বলতে পারবেন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ বন্ধ। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে সাংসদ লিটন সাহেব একজন কিশোরের পায়ে গুলির প্র্যাকটিস করেছেন। মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো রাস্তা আটকিয়ে। লাখ লাখ মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্টে রেখে আওয়ামী লীগ সংবর্ধনা কর্মসূচি পালন করল।
আমরা অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ এবং ‘আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্তিতে আনন্দিত ও গর্বিত। আমরা সানন্দে তাকে সংবর্ধিত করতে চাই। তার জন্য আরো অনেক সুন্দর-সুন্দর জায়গা আছে। রাস্তা বন্ধ করে জনগণের দুর্দশা বাড়িয়ে এবং সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে এমন সংবর্ধনা কেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন বেলা দেড়টায়। অথচ বেলা ১১টা থেকে রাস্তা বন্ধ করে আনন্দে নাচানাচি করায় সংবর্ধনার মান বৃদ্ধি হয়নি। উল্টো মানুষের যে ভোগান্তি দেখা গেছে তা অবিশ্বাস্য এবং তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমে সেদ্ধ হয়ে রাজধানীর পাবলিক বাসযাত্রীদের আলোচনা সমালোচনার বিষয় ছিল এই ধরনের সংবর্ধনার আয়োজন নিয়ে।
একজন সাংসদ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাতে মদপান করেন আর দিনের বেলা ঘুমান। তার কর্মকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ভীষণ বিরক্ত এবং হতাশ। কিন্তু তাদের কথা শোনার কেউ নেই। তাদেরও বলার কিছু নেই। কারণ, সাংসদ হলেন স্থানীয় সম্রাট। তার হুকুম ছাড়া সেখানে কিছুই হয় না। তাকে কিছু বলা মানে পয়সা দিয়ে নিজের বিপদ কিনে আনা। সাংসদ লিটন সাহেব স্থানীয় থানায় অস্ত্র জমা দিয়ে গা ঢাকা দিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পুলিশ তাকে ধরেছে এবং তাকে আদালতেও হাজির করা হয়েছে। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
তবে ব্যবস্থা কেন সেদিনই নেওয়া হলো না এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল ওই সাংসদকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। এমন দাবি তিনি করতেই পারেন। কারণ, তিনি আমজনতার কাতারে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। যদি তিনি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা হতেন তাহলে এই দাবি করতেন না।
সাংসদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সুন্দরগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে, মানববন্ধন হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারের দাবিতে এলাকাবাসী সোচ্চার। এই মানুষগুলো এত দিন এমন করে রাস্তায় নামেনি। তাহলে তাদের রাস্তায় নামালো কে? সেই ব্যক্তিরা কারা?
তার চেয়েও বেদনার ব্যাপার হলো মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা। তিনি বললেন, ‘যত আন্দোলনই হোক পরীক্ষা বাতিল হবে না। কারণ প্রশ্ন ফাঁস হয়নি।’
অথচ প্রশ্ন যে ফাঁস হয়েছে সে কথা সরকারই তার কর্মকাণ্ডে স্বীকার করেছে। র্যাব রংপুর থেকে তিনজন সিনিয়র ডাক্তারকে গ্রেফতার করেছে। সঙ্গে কোচিং সেন্টারের চারজন কর্মকর্তাকেও। প্রশ্ন যদি ফাঁস না হবে তাহলে তিনজন সম্মানীয় ডাক্তারকে এইভাবে অপদস্থ করা হলো কেন? কেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন সহকারী পরিচালককে ধরে রিমান্ডে নেওয়া হলো? তারপর সহকারী পরিচালক হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করলেন। বিএনপির আমলে যখন র্যাব গঠন করা হয় তখন র্যাব যাকেই ধরত তারই হার্ট অ্যাটাক হতো। সেই প্রবণতা আবার শুরু হলো কি না- সেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামেনি। তারা বলছে প্রশ্ন ফাঁসের যথেষ্ট প্রমাণ তাদের হাতে আছে। প্রয়োজনে তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সামনে তা উপস্থাপন করবেন। এদিকে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর অমানুষিক হামলা চালাচ্ছে। তাদের হামলায় ৭ অক্টোবর ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করলে কি ক্ষতি হতো? বরং সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা করবে বলে মনে হয় না। তাদের কাজ দেখে মনে হয় বিএনপি-জামায়াতের লবিস্টরা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য যা যা করছে, তার চেয়ে আওয়ামী লীগই বেশি তৎপর সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গল্পকার, টিভি নাট্যকার।