খোলা বাজার২৪ ॥ বুধবার, ২১ অক্টোবর ২০১৫ :ক্যানসারের সঙ্গে সর্বশেষ অসম যুদ্ধের কাল পেরিয়ে এসেছি বছর আটেক আগে। সর্বশেষ বলার কারণ, প্রথমে আমার মা, এরপর আমার স্ত্রী—এ দুজন মানুষের ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে পাশে থেকেছি আমি। দুজনেই এখন পর্যন্ত ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। এ অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক পরিণত আর সাহসী করেছে। আজ এই যুদ্ধ জয়ের কাহিনি হয়তো নতুন করে কাউকে সাহস জোগাবে, তাই বলা। এই দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি দিনের সহস্র ক্ষত সামলে বুকে হেঁটে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার যে কষ্ট আর যন্ত্রণা, তা কহতব্য নয়।
নিডল বায়োপসির রিপোর্টটায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল—ডাক্টাল কারসিনোমা। ক্যানসার। মুহূর্তে আমার স্ত্রীর মুখটিই ভেসে উঠেছিল কেবল। যার রিপোর্টটা আমার হাতে। সে অনুভূতি বোঝানো সম্ভব নয়। কষ্ট সামলে সবার আগে যা মনে হয়েছিল, তা হলো, পিছু হটা যাবে না। সামনে এগোতে হবে। যে মানুষটি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ; কোনো কিছু গোপন না করে, পাশে থেকে বুদ্ধি-শক্তি-সাহস জুগিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। পরে দেখেছি, ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তাঁর মনের সাহস। ক্যানসার হয়েছে, এ তথ্য জানার পর মুহূর্তেই পাল্টে যায় আক্রান্ত মানুষটির চেনা পৃথিবী।
সবার আগে যে বিষয়টির মুখোমুখি হয়েছি আমরা, সেটা হচ্ছে, ক্যানসার নিয়ে ছড়ানো নানা ভীতিকর গুজব। অনেকের গল্পেই সে সময় উঠে এসেছিল নানা নেতিবাচক বাস্তবতা। সেসব গল্পের ডালপালা মেলতে থাকে মাংসাশী উদ্ভিদের লতানো আঁকশির মতো। দুঃস্বপ্নেও হানা দেয় তা। একেকটা সময় খুব অসহায় আর নিঃসঙ্গ বোধ করার বিষয়টা খেয়াল করেছি। এমনকি চিকিৎসার মাঝামাঝি সময়ে যখন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি চেপে বসেছিল আমার স্ত্রীর শরীর ও মনে, সে সময় ‘চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে তো?’, এমন সন্দেহও তৈরি হয়েছে বহুবারই। অসংখ্য নির্ঘুম রাত এর সাক্ষী। সে সময় শত-সহস্রবার নিজেকে বোঝাতাম, ঘাবড়ানো যাবে না একদম। কারণ, আমি ঘাবড়ে গেলে শতগুণ অসহায় হয়ে পড়বে আমার প্রিয়তম মানুষটি।
সুচিকিৎসা কিংবা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা জেনেছিলাম খ্যাতনামা এক রেডিও অনকোলজিস্ট গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকের সংস্পর্শে আসার পরই। এর আগের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। একজন প্রবীণ চিকিৎসক, যিনি সার্জনও, শুধু নিডল বায়োপসি রিপোর্ট দেখেই ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষটির সামনে রীতিমতো হুংকার দিয়ে উঠেছিলেন, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে।’ পারলে তিনি তখনই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেন। আরেকজন চিকিৎসক হেলাফেলায় জানিয়েছিলেন, কেমো দিয়ে দেবেন, সেরে যাবে। আজ বুঝি, এই দুই মানসিকতার কোনোটিই অপকার ছাড়া ক্যানসারে আক্রান্তের কোনো উপকারে আসে না।