Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

এখানে একটি ‘তবে’ আছে। তরিকুল আলম অন্য কোনো বিদ্যালয়ে চাকরি নেননি। একাধিক কিন্ডারগার্টেন থেকে সে প্রস্তাব পেয়েওছিলেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন ভিন্ন পন্থা। জেলার যেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকসংকট আছে, সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন তিনি। পাঠদান করছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা তাঁকে ডাকছেন। তাঁর মুঠোফোন নম্বর আছে শিক্ষার্থীদের কাছেও। তারাও তাঁকে ফোন করে তাদের বিদ্যালয়ে যেতে অনুরোধ করছে। আর ছুটে যাচ্ছেন তরিকুল আলম। সব করছেন বিনা পারিশ্রমিকে।
তরিকুল আলম চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষ্ণগোবিন্দপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিন বছর আগে অবসর নিয়েছেন। বয়স এখন ৬০। সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি বিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে ঘুরে ঘুরে পাঠদান করছেন তিনি।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এক দুপুরে সদর উপজেলার তাজকেরাতুন স্বরূপনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠদান করছেন তরিকুল আলম। পাঠদান শেষে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক আমগাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। শ্রেণিকক্ষগুলো থেকে ভেসে আসছিল শিক্ষার্থীদের কোলাহল।
অবসর নেওয়ার পরও কেন প্রতিদিন আগের মতোই বিদ্যালয়ের উদ্দেশে বের হচ্ছেন—এ প্রশ্নের জবাবে তরিকুল আলম বললেন, ‘প্রথম দু-এক দিন বাড়িতে বসে থেকে আমি অস্থির হয়ে উঠি। মনে হলো, শিশুশিক্ষার্থীদের কচি কচি মুখগুলো দেখা থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি। ওদের কলকাকলি, ওদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি।’
তরিকুল আলম জানান, শুরুতে নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ে যেতেন। এখন অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই মুঠোফোনে তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরাও সুযোগ করে দেন। এভাবেই এখন চলছে।
তবে তরিকুল আলমের এই আনন্দ একতরফা নয়। তাজকেরাতুন স্বরূপনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী নিশাত তাবাসসুম বলল, ‘স্যারের ক্লাস খুব ভালো লাগে। আমরা অনেক আনন্দ পাই। স্যারকেও আমাদের খুব ভালো লাগে।’ একই রকম মন্তব্য কামরুন্নাহার, মারুফা আক্তারসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীর।
তাজকেরাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম এবং আজাইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘মাঝেমধ্যেই তরিকুল স্যার এসে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন। এতে আমাদের উপকারই হয়।’
কৃষ্ণগোবিন্দপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবা খানম বলেন, ‘এমন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক জেলায় খুব কমই আছেন। একটি দিনের জন্যও তিনি বিদ্যালয়ে দেরি করে আসেননি। শিক্ষার্থীরা তাঁর পাঠদানে আনন্দবোধ করত। তিনি কাবস্কাউটেরও শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করি।’
এই জনপ্রিয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিন্তু পরিবারের সদস্যদের অনুযোগ আছে। তরিকুল আলমের বড় ছেলে সারোয়ার হোসেন বললেন, ‘বাবা সংসারের প্রতি একটু উদাসীন। মাঝে মাঝে খারাপ লাগে, বিরক্ত হই। আবার বাবার জন্য গর্ববোধও করি।’ তিনি পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পাওয়ার উপযোগী শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা করেন। উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে—এমন মেধাবীদের বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা সংগ্রহ করে থাকেন বলে জানান সারোয়ার।
সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাড়ি সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের গোয়ালটুলী গ্রামে। এ গ্রামেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ইউনিয়নেও আছে অনেক বিদ্যালয়। মাসহ আমরা ভাইবোনেরা বাবাকে অনুরোধ করি, গ্রামের বিদ্যালয় বা আশপাশের বিদ্যালয়গুলোতে যেন পাঠদান করেন। কিন্তু না, তিনি কারও কথাই শোনেন না। চলে যান দূরদূরান্তে। প্রায় দিনই বাবাকে মোটরসাইকেলে করে দূরের বিদ্যালয়ে রেখে আসি। বিশেষ কোনো কারণে যেতে না পারলে তিনি নিজেই বাইসাইকেল চালিয়ে চলে যান। ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের প্রতিটি দিনই তাঁর বিদ্যালয়ে যাওয়া চাই। বৃষ্টি-বাদল কিছুই তাঁকে থামাতে পারে না।’
সম্প্রতি কৃষ্ণগোবিন্দপুর কলেজ মাঠে সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার আট ইউনিয়নের ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত শিক্ষা মেলায় তরিকুল আলমকে এলাকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। সদর উপজেলার রানিহাটি ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সাধারণ পাঠাগার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘যেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে, সেসব বিদ্যালয়ে স্যার বেশি বেশি যান। তিনি শুধু শিক্ষকতা নিয়েই থাকেন না, সমাজসেবামূলক কাজও করেন। এলাকার একাধিক কেজি স্কুল স্যারকে নিয়োগ করতে পীড়াপীড়ি করেছে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান করে যাচ্ছেন। এই যুগে এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষের সংখ্যা খুবই কম।’
স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তরিকুল আলমের পরিবার। এক ছেলে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস। আরেক ছেলে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) পাস করেছেন। এক মেয়ে স্নাতক শ্রেণিতে এবং আরেক মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছেন।
তরিকুল আলমের স্ত্রী খোদেজা বেগম বললেন, ‘দূরের বিদ্যালয়ে গেলে বাড়ি ফিরতে অনেক সময় রাত হয়ে যায়। বয়স হয়েছে বলে তাঁর শরীর নিয়েও দুশ্চিন্তা হয়। তবে যে কাজ করে উনি ভালো থাকবেন, সেই কাজই যেন তিনি করেন।’ সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেও তরিকুলের কোনো অবহেলা নেই—এই তথ্যও দিতে ভুললেন না খোদেজা বেগম।
তবে তরিকুল আলমের কথা, ‘আমি শিশুদের ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারি না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, পাঠদান করতে করতে বা বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথেই যেন আমার মৃত্যু হয়।’