খোলা বাজার২৪ ॥মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর ২০১৫: আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির প্রতি দারুণ কৃতজ্ঞ আমিনুল ইসলাম। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে যে ব্যাটটি দিয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি, সেটা প্রায় জোর করেই তাঁর কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ক্রিকেট সংগঠক। বলেছিলেন, ওটা জাদুঘরে দেবেন। সাজ্জাদুল আলম তাঁর কথা রেখেছেন, ব্যাটটা এখন লর্ডসের জাদুঘরে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই আছে।
ফফ৫৫৪১৬ফবধপ৪১প৯প৯৭নধপব৩ন১ভ৯২৪২ধব-৪আমিনুলের কাছে থাকলে নাকি সেই ব্যাটটার কোনো যতœ হতো না। পুরোনো ব্যাটের প্রতি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একটা আলাদা দুর্বলতা কাজ করে তাঁর। কোনো ব্যাট দিয়ে ভালো ইনিংস খেললে তো আর কথাই নেই। ওটা দিয়েই খেলে যেতেন ম্যাচের পর ম্যাচ। আমিনুল বললেন, ‘ববি ভাই (আহমেদ সাজ্জাদুল আলম) ওটা ভাগ্যিস আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার কাছে থাকলে ব্যাটটা হয়তো নষ্টই হয়ে যেত।’
এই তো সেদিন ছেলেদের নিয়ে ঢুঁ মেরেছিলেন লর্ডসের সেই বিখ্যাত জাদুঘর। অজস্র স্মারকের ভিড়ে নিজের ব্যাটটা দেখেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। ওটাকে পেছনে রেখে ছবি তুললেন। অসম্ভব এক গর্বের অনুভূতি মুহূর্তেই গ্রাস করল তাঁকে। চোখের কোণে একটু জলও কী উঁকি দিয়ে গেল না! দেশের প্রথম টেস্টে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি যে এসেছিল এই ব্যাটটা দিয়েই। বাবার আবেগ ছুঁয়ে গেল ছেলেদেরও। আমাদের বাবা আর দশটা সাধারণ বাবা নয়, বাবা যে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই অংশ।
দেখতে দেখতে পনেরোটি বছর কেটে গেল। কিন্তু আমিনুলের কাছে মনে হয় ঘটনাটা সেদিনের। খুব বাজে ফর্ম যাচ্ছিল তাঁর। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার মুহূর্তে অধিনায়ক ছিলেন, কিন্তু অভিষেক টেস্টের লগ্ন আসতে আসতেই অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। খুব হতাশার সময় নির্বাচকেরা তাঁর প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। আমিনুলও দিয়েছিলেন আস্থার প্রতিদান। আজ এত বছর পর পেছন ফিরে তাকিয়ে খুব অবাক লাগে তাঁর। দেশের টেস্ট অভিষেকের সঙ্গে নিজের টেস্ট অভিষেকের একাকার হয়ে মিশে যাওয়া, তাতে আবার ইতিহাসের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি! আমিনুলের হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তোলে পনেরো বছর আগের সেই অনুভূতি।
২০০০ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর—স্বপ্নময় এক জগতে বাস ছিল আমিনুলের। কেবল আমিনুল কেন! বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে মাঠে নামা ১১ ক্রিকেটারই এই চারটি দিন এক ধরনের ঘোরের মধ্যে বাস করেছিলেন। স্বপ্নের শেষটা অবশ্য ভয়ংকর। আকাশে উড়তে উড়তে হঠাৎ মাটিতে পতন! দারুণ খেলতে খেলতে অভিষেক টেস্টের যাচ্ছেতাই পরিসমাপ্তি। আমিনুলকেও কষ্ট দেয় সে ব্যাপারটা, ‘স্বপ্নের শেষটা ভালো হতে পারত। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার বড্ড অভাব ছিল তখন। পেশাদারিরও ঘাটতি ছিল। অভিষেক টেস্টের প্রথম সাড়ে তিন দিন আমরা যে ধরনের ক্রিকেট খেলেছিলাম, তাতে ম্যাচটা অন্তত ড্র হওয়া উচিত ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯১ রানে অলআউট না হয়ে রানটা আরও বাড়িয়ে ভারতকে আরও বড় লক্ষ্যমাত্রায় ব্যাট করাতে পারলেও দুঃখ থাকত না।’
অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরির ইনিংসটা ক্রিকেট বিশ্বে অন্যরকম পরিচয় দিয়েছিল আমিনুলকে। সেই ইনিংসটি খেলার সময় নাকি একেবারেই ভিন্ন কোনো অনুভূতি হয়নি তাঁর, ‘প্রথম আধ ঘণ্টা একটু নড়বড়ে ছিলাম। বাজে ফর্মে ছিলাম বলেই হয়তো বা। কিন্তু কয়েকটা শট খেলার পরই আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পেলাম। দেশের অভিষেক টেস্টের রোমাঞ্চই কাজ করছিল তখন। অনুভূতিটা ছিল গর্বের। কিন্তু শ্রীনাথ, জহির খান সুনীল জোশিদের বিশেষ কিছু মনে হয়নি তখন। মনে হচ্ছি ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে কোনো ম্যাচ খেলছি।’
আমিনুল সেঞ্চুরির মাইলফলক অতিক্রম করেন টেস্টের দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্ন বিরতির পরপরই। কিন্তু তাঁর এই অসাধারণ কীর্তির খবরটি রসিয়ে রসিয়ে পড়তে পাঠকদের অপেক্ষা করতে হয়েছে মাঝের গোটা একটা দিন। পবিত্র শবে বরাতের কারণে টেস্টের দ্বিতীয় দিন পত্রিকা অফিসে ছুটি ছিল। কিন্তু এমন অনন্য গৌরবগাথা সাংবাদিকেরা কী না লিখে থাকতে পারেন। তখন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বলতে কেবল একটি (একুশে টিভি), সংবাদমাধ্যমে হিসেবে অনলাইন তখনো দূরের ব্যাপার। এমন অসাধারণ মুহূর্তটি ধরে রাখতে সাংবাদিকেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ভিন্ন মাধ্যমের। দেশের সেরা ক্রিকেট লেখকেরা মিলে শবে বরাতের ছুটির মধ্যেই বের করেছিলেন ‘প্রেসবক্স’ নামের একটি পত্রিকা। আমিনুলের সেঞ্চুরিটি নিয়ে সেখানে ঠাঁই পেয়েছিল দেশ-সেরা সাংবাদিকদের আসা ধারণ সব লেখা।
আমিনুলের খুব যতেœর সঙ্গে আজও রেখে দিয়েছেন ‘প্রেসবক্সের’ একটি কপি। কাজের ফাঁকে অবসরে মাঝে-মধ্যে সেই পত্রিকাটির লেখাগুলোতে চোখ বোলান, ‘লেখাগুলো আমার কাছে কোনো দিন পুরোনো হবে না। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার সেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল সাংবাদিক ভাইদের লেখাগুলোয়। নিজেকে খুব তৃপ্ত মনে হয়েছিল সেদিন।
আমিনুল আজও তৃপ্ত। দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের অংশ হতে পারার তৃপ্তি যে কী, সেটা তিনি ছাড়া ভালো আর কে বোঝেন