Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

4kড. গোলাম কিবরিয়া পিন : প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রায় সব দেশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় বা একমাত্র ভাষার মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত দেশসমূহÑ বিশেষত ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানিতে প্রাথমিক স্তরে প্রথম ভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের দেশে ভাষা বিষয়ে বিভিন্নমুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি।
প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে কোথাও কোথাও ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। নানা রকমের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাণিজ্য ভেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। ‘ইংরেজি মাধ্যম’, ‘কিন্ডারগার্টেন’, ‘প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসা’ নামের তথাকথিত প্রাথমিক শিক্ষালয় নগর-শহর ও বন্দরে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই প্রাথমিক শিক্ষার মূল দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে। এসব শিক্ষালয়ের পাঠ্যসূচির কেনো সামঞ্জস্য নেই, নেই শিশু মনস্তত্ত্বের প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষা। এসব তথাকথিত শিক্ষালয়ে বাংলাভাষাকে অনেকাংশে অবজ্ঞা আর অবহেলায় টেনে নিয়ে এক কোণায় রাখা হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এক উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের অবৈজ্ঞানিক এবং অযুক্তিপূর্ণ মন-মানসিকতা।
ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও শরীর-বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছেন যেÑ প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাই শিক্ষার একমাত্র বাহন হওয়া উচিত। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর অনেক গবেষণা ও সমীক্ষা করা হয়েছে। এসব গবেষণা ও সমীক্ষায় প্রাথমিক স্তরে একটি মাত্র ভাষায় শিক্ষাদানের নির্দেশনা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে দু’টি ভাষায় শিক্ষা শিশুকে নিুমানের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, শিশুর স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে, উপলব্ধির ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, শব্দ ভাণ্ডারের ওপর দখল বাড়ায় না, শিশুর বিকাশের পথ বাধাগ্রস্ত করে। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা শেখালে শিশুর অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার ক্ষমতা ও দক্ষতা হ্রাস পায়।
শরীর-বিজ্ঞানীরাও তাঁদের গবেষণালব্ধ আরও অভিমত দিয়ে বলেছেন যে, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার বাহন একমাত্র মাতৃভাষা হওয়া উচিত। তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, শিক্ষার ওপর øায়ুতন্ত্রের সম্পূর্ণ আধিপত্য থাকে। øায়ুজগৎ ছাড়া ভাষা শিক্ষা অসম্ভব। øায়ুতন্ত্রের এলাকাগুলো খুব প্রণালীবদ্ধ, একের সঙ্গে অন্য পরস্পরভাবে জড়িত। মানব শিশুর শিক্ষায় যদি এ প্রণালী নষ্ট হয়, তবে তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু ভাষা শেখে পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে। শিশুর পরিবেশে থাকে স্বাভাবিকভাবে তার মাতৃভাষা। মা ও পরিবারের অন্যান্যরা শিশুদের আদর করে, কথা বলে, ঘুম পাড়ায়, এটা-ওটা চিনিয়ে দেয় মাতৃভাষায়। মানব শিশুর কান দিয়ে শোনার এলাকা ও কথা বলার এলাকা খুবই কাছাকাছি। মাতৃভাষায় পরিচিত ধ্বনিরাশি সংজ্ঞাবহতন্ত্র দিয়ে শ্রবণনিয়ন্ত্রণ এলাকা হয়ে কথা বলার এলাকায় অনায়াসে মুদ্রিত হয়। শিশু শুনে, বোঝে ও বলে ভাব প্রকাশের দক্ষতা অর্জন করে। এভাবে øায়ুতন্ত্রের সাথে মাতৃভাষাগত পরিবেশের সম্পর্ক রয়েছে। ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর শিক্ষা শুধু বাধাপ্রাপ্ত হয় না, শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশও বিলম্বিত হতে পারে।
সীমিত সংখ্যক উ”চাভিলাষী পরিবার বা লোকদের স্বার্থে সমগ্র দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর অপ্রয়োজনীয় ও যুক্তিহীন চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এদের উ”চাকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সকল শিশুদের ওপর ইংরেজি বা আরবি চাপিয়ে দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। মাধ্যমিক স্তরের আগ পর্যন্ত মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভিন্ন ভাষা অন্যস্তরে বা অন্যভাবে শেখা যেতে পারে। মাতৃভাষার শিক্ষা সাবলীল হলে অন্য ভাষা ভালো করে আয়ত্বে আনা সম্ভব। অন্য ভাষা শিখবার আগে মাতৃভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করার বিকল্প নেই।
ইংরেজি শিক্ষার মান নিচু হয়ে গেছে বলে অনেকে কাতরান! কিন্তু তারা কি জানেন না যে, শুধু ইংরেজি কেন, মাতৃভাষার মান কি শিক্ষা ক্ষেত্রে বেড়েছে? অথবা শিক্ষার সামগ্রিক মান কি আমরা এখনো উন্নত পর্যায়ে কাক্সিক্ষতভাবে নিয়ে আসতে পেরেছি? শিক্ষাসংক্রান্ত বহু সমস্যা এখনো অনেকক্ষেত্রে আমরা দূর করতে পারিনি। ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞ থেকেও চীন ও জাপান আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ শিল্প-বাণিজ্যে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। সর্বাধুনিক কম্পিউটার, জৈবপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে চীনা ও জাপানিরা বিদেশি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে। সেখানে প্রয়োজনে অনুবাদব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
আমাদের শিশুদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলার মাধ্যমেই শিক্ষার সুযোগ অবারিত করা প্রয়োজন। মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমেই মানবিক-নৈতিক-বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বাধামুক্ত পথ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে হবে, সেই উজ্জ্বলতায় শিশুরা হয়ে উঠবে একেকজন আলোকিত মানুষ। আর এই আলোকিত মানুষেরা কখনো মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করবে না, অবজ্ঞা করবে না দেশ ও দেশের ঐতিহ্য।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক