খোলা বাজার২৪,বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ ২০১৬: বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে গত মঙ্গলবারের সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নেওয়া আত্মঘাতী হামলাকারীদের মধ্যে দুজন সম্পর্কে ভাই। হামলার প্রধান সন্দেহভাজন গতকাল বুধবার পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। এই হামলাকারীদের সঙ্গে ফ্রান্সের প্যারিসে গত নভেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্তকারী ও কৌঁসুলিরা এ কথা বলেছেন।
ব্রাসেলসের জাভেনতেম বিমানবন্দর ও ম্যালবিক মেট্রো স্টেশনে (পাতালরেল) মঙ্গলবার সকালে কাছাকাছি সময়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। পরে এর দায় স্বীকার করে আইএস। এক ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটা এই জোড়া হামলায় ৩১ জন নিহত ও ২৭০ জন আহত হয়েছে বলে গতকাল বুধবার দাপ্তরিকভাবে জানিয়েছে দেশটির সরকারি কর্তৃপক্ষ। তবে মেট্রো স্টেশনে হামলায় অনেকের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে লাশ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ায় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় কৌঁসুলি ফ্রেডরিক ভন লিউ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সন্দেহভাজন দুই আত্মঘাতী হামলাকারীর নাম প্রকাশ করেন। তাঁরা হলেন খালিদ আল বকরাউয়ি (২৭) ও ব্রাহিম আল বকরাউয়ি (২৯)। ব্রাহিম বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেন। বিমানবন্দরের সিসিটিভিতে ধরা পড়া ট্রলি নিয়ে হাঁটতে থাকা তিন সন্দেহভাজনের মাঝের জন তিনি। বিস্ফোরণের ঘটনার ঠিক আগে ব্যাগভর্তি ট্রলি নিয়ে এই তিনজন বহির্গমন হলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ছবিতে ব্রাহিমের পাশের দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাঁদের একজন নিহত হয়েছেন এবং অন্যজন পালিয়ে গেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ম্যালবিক মেট্রো স্টেশনের হামলায় অংশ নেন ব্রাহিমের ভাই খালিদ। তিনি ট্রেনের একটি বগির গায়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেন। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কৌঁসুলি ভন লিউ জানান, হামলাকারী দুই ভাই খালিদ ও ব্রাহিম পুলিশের কাছে পরিচিত ছিলেন। দুজনেরই অপরাধের অতীত ইতিহাস রয়েছে। তবে তা সশস্ত্র ডাকাতি-সংক্রান্ত; সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
বেলজিয়ামের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আরটিবিএফ বলেছে, প্যারিস হামলার প্রধান সন্দেহভাজন সালাহ আবদেসালামের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে খালিদ ও ব্রাহিমকে ধরতে আগে থেকেই অভিযান চালাচ্ছিল পুলিশ। আবদেসালামের খোঁজে গত সপ্তাহে ব্রাসেলসের ফরেস্ট নামের এলাকার যে গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ একজনকে হত্যা করে, সেটি ভুয়া নামে ভাড়ায় নিয়েছিলেন খালিদই।
হামলার প্রধান সন্দেহভাজনকে নিয়ে গতকাল নানা নাটকীয়তা হয়। পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট গতকাল ব্রাসেলসের অ্যান্ডারলেখট এলাকায় অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে তাঁর পরিচয় গোপন রাখা হয়। এরপর স্থানীয় গণমাধ্যমে চাউর হয়, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নাম নাজিম লাশরাউয়ি (২৫)। তিনিই হামলার ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন।
তবে কৌঁসুলি ভন লিউ এমন খবর অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, হামলার প্রধান সন্দেহভাজন এখনো পলাতক।
নাজিম লাশরাউয়ি প্যারিস হামলার ঘটনায় পরোয়ানাভুক্ত আসামি। ওই হামলায় ব্যবহৃত অন্তত দুটি বিস্ফোরক বেল্টে তাঁর ডিএনএ পাওয়া যায়। এ ছাড়া গত শুক্রবার ব্রাসেলসের যে গোপন আস্তানা থেকে আবদেসালামকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেখানেও নাজিমের ডিএনএ পাওয়া গেছে।
গার্ডিয়ান পত্রিকার খবরে বলা হয়, নাজিমকে গত সেপ্টেম্বরে একবার অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সীমান্তে থামিয়েছিলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। তিনি আবদেসালামের সঙ্গে গাড়িতে করে সেখানে গিয়েছিলেন। নাজিম প্যারিস হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরির কারিগরদের অন্যতম বলে মনে করা হচ্ছে।
জাভেনতেম বিমানবন্দরের সিসিটিভিতে ধরা পড়া তিন সন্দেহভাজনের মধ্যে সবার ডানে থাকা হ্যাট পরা ব্যক্তিটিকে নাজিম বলে মনে করা হচ্ছে। সিসিটিভির ভিডিওতে দেখা যায়, অন্য দুই হামলাকারীর সঙ্গে তিনিও ট্রলি ঠেলে সামনে এগোচ্ছেন। বিস্ফোরণের ঘটনার পর তিনি টার্মিনাল থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক খবরে বলা হয়, মরক্কোয় জন্ম নেওয়া নাজিম বেড়ে ওঠেন ব্রাসেলসের শায়েরবিক এলাকায়। স্থানীয় একটি ক্যাথলিক হাইস্কুলে তিনি ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। বেলজিয়ামের প্রসিকিউটরের কার্যালয় বলেছে, ২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারিতে নাজিম সিরিয়ায় গিয়ে বোমা তৈরির কৌশল রপ্ত করেন বলে তারা মনে করছে।
খালিদের নোট: কৌঁসুলি ভন লিউ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আত্মঘাতী হামলাকারী খালিদের একটি নোট পাওয়া গেছে। এতে তিনি লিখেছেন, পুলিশ তাঁর পিছু নিয়েছে। কোনো জায়গা তাঁর জন্য নিরাপদ নয়। এখন কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
বোমা তৈরির সামগ্রী উদ্ধার: এএফপির খবরে বলা হয়, পুলিশ গতকাল ব্রাসেলসের শায়েরবিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস ব্যাপকভাবে এই বিস্ফোরক ব্যবহার করে থাকে। এসব সরঞ্জামের সঙ্গে বিমানবন্দর ও মেট্রো স্টেশন থেকে সংগৃহীত আলামতের মিল রয়েছে।
হতাহত ব্যক্তিরা ৪০ দেশের নাগরিক: বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিদিয়ের রেইন্ডার্স আরটিবিএফকে বলেন, হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৪০টি দেশের নাগরিক রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, মরক্কো ও পর্তুগালের নাগরিক। তাঁদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাহী সংস্থা ইউরোপীয় কমিশনের তিন থেকে চারজন কর্মীও রয়েছেন।
এক মিনিট নীরবতা: দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের স্মরণে গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে বেলজিয়ামবাসী। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের অংশ হিসেবে এ কর্মসূচি পালিত হয়।
বিমানবন্দর আজও বন্ধ: হামলার শিকার জাভেনতেম বিমানবন্দর আজ বৃহস্পতিবারও বন্ধ থাকবে। বিমানবন্দরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরনাউদ ফিস্ত গতকাল এক টুইটার বার্তায় এ কথা বলেছেন।