অজয় দাশগুপ্ত: এখন উড়ালের যুগ। মানুষ মাথার ওপর দিয়ে চলতে ভালোবাসে। একসময় উড়াল মানে বোঝাতো আকাশে উড়তে যাওয়া। সেদিন নেই। উড়াল মানে মাটি থেকে শূন্যে উঠলেই হলো। আমাদের দেশের মত দেশগুলো মানে জনবহুল দেশে মানুষের স্থান সংকুলান এক বিরাট সমস্যা। বিশেষত বড় বড় শহরে বা রাজধানীতে তিল ধারণেরও ঠাঁই নেই। তা বলেতো আর জীবন থেমে থাকবে না। মানুষকে জায়গা করে দিতেই হবে। হংকং সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের মত ঘনবসতির দেশগুলো যা করেছে আমরাও তা করতে শিখেছি। রাজপথে যখন জায়গা নেই মাথার ওপর চলাচলের জায়গা করে দিয়ে বলেছি এসো। এর নাম ফ্লাইওভার। ওপরে ওঠো মানুষ। জীবন-যাপনের তাগিদে সাধারণ মানুষকে যেটা দেয়া হবে সেটাই সে লুফে নেবে। তাছাড়া এটা কোনো খারাপ আইডিয়াও নয়। কিন্তু খারাপটা হচ্ছে আমাদের অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি।
গত মাসের এক তারিখে কলকাতা থেকে ফিরলাম। হিল্লি-দিল্লি লাহোরের বর্ডার ঘুরে কলকাতা ছিলাম কয়েকদিন। মমতার আত্মম্ভরী রাজ্যে চারদিকে কেবল প্রশংসা আর স্তুতির ধুলো। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে পথে পথে যেসব বিলবোর্ড ও কাট আউট তাতে ঢাকাও লজ্জায় মুখ লুকাবে। বাঘা বাঘা গোঁফ দাড়িওয়ালা নেতারা কাট আউটে বা বিলবোর্ডে তার পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে বসে আছেন। সর্বত্র তার দাপট। সে দাপটের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ঢাকা পড়ে গেছে কলকাতার সৌন্দর্য। আমার রীতিমত বিরক্ত লেগেছে। কোথাও যাওয়া যায় না। সর্বত্র খালি ফ্লাইওভারের ছড়াছড়ি। আর বেশিরভাগই হয় অর্ধসমাপ্ত নয়তো কোনোরকমে দায়সারা কাজ হবার পরপরই ভোটের জন্য খুলে দেয়া। শুকনো খতে যেমন মাছি ভনভন করে এগুলোর পলেস্তরা খসে আসা দেয়ালে তেমনি ছোপ ছোপ দাগ আর ধুলোর রাজত্ব। কোনো ব্যতিক্রম নেই ঢাকার মত একই দৃশ্য। পুল বা ফ্লাইওভার ছাড়িয়ে মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর মাথার ছবি। বোঝার কেউ নেই এদেশে বা আমাদের মত দেশে নিয়ম মানে না কেউ। যে যার মত গতিতে ছুটছে। ওভারটেক করতে গিয়ে কখন যে এসব বাতিতে ধাক্কা দিয়ে বৈদ্যুতিক অঘটন ঘটাবে সেটা মাথায় রাখেনি কেউ। দু’দিন আগে বাগবাজার এলাকায় বিবেকানন্দ উড়াল সেতুটি ভেঙে পড়ে কলকাতায় যে অঘটন ঘটালো তা কিন্তু মর্মান্তিক। আমারতো ধারণা হচ্ছে এর তলা দিয়ে আমরাও যাতায়াত করে এসেছি। দৈবক্রমে বেঁচে গেছি হয়তোবা। যেকোনো মুহূর্তে যে কোনো মানুষ এর শিকার হতে পারেন।
একটা বিষয় খেয়াল করুন কেউ সবুর করছে না। ভালো করে কোনো কিছু শেষ হতেও দিচ্ছে না। কোনো সেতু যদি হাফ ডান বা অর্ধসমাপ্ত হয় তাকে খুলে দেয়ার মানে কি? আমরা বিজ্ঞানের ছাত্র না হতে পারি এটাতো বুঝি শরীরের মত পায়ের ভার ছাড়া কোনো মানুষকে হাঁটতে দিলে সে আছাড় খেয়ে পড়বেই। তার চাই হুইলচেয়ার। সেটা মানা হয়নি। কারণ রাজনীতি। কি পশ্চিমবঙ্গ আর কি আমাদের বঙ্গ সবকিছু রাজনীতির খেলা। ইলেকশান কাছিয়ে এলে বা কোনো ইস্যু থাকলে সেতু তো সেতু যেকোনো কিছুই খুলে দেয়া হবে। সেটা যদি কারিগরি দিক থেকে আনফিটও হয় কারো কিছু যায় আসে না। কারণ মানুষের চেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য আর কিছু নেই। কি আশ্চর্য ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। শুনি তাদের নাকি জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতাও অনেক বেশি। সেদেশের একটি বড় নগরীর প্রাণকেন্দ্রে উড়াল সেতু ভেঙে মানুষ মরলো মানুষ চাপা পড়ে রইলো, যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো। কি নির্মম নিষ্ঠুর হূদয় বিদারক ঘটনা। আর এর নির্মাতা হায়দ্রাবাদের ঠিকাদার বলেছেন ভগবান স্বয়ং নাকি এটা ভেঙে দিয়েছেন। ঈশ্বরও এখন অসহায় বটে। না হলে এর গালে একটা আসমানী চড়ই যথেষ্ট ছিল। আসলে বিষয়টা কিন্তু গভীর বেদনার। দায়-দায়িত্ব নেয়ার পরিবর্তে এমন মারফতি কথা আমাদের দেশেও বলা হয়। আমাদের শীর্ষ নেতা মন্ত্রীরা ইট চাপা পড়া মানুষের জীবনকে তুচ্ছ করে বলেন কেউ নাকি ভবন ধরে ঝাঁকিয়েছিল। এই বাচালতা মানুষের কাম্য নয়।
আমরা উন্নত দেশে দেখি কোনো কাজ দিনের আলোয় হয় না। মানুষ ঘুমিয়ে গেলে বিকল্প রাস্তা তৈরি করে উপযুক্ত সরঞ্জাম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তারপর নির্মাণ কাজ করা হয়। একদিন ওয়ান ফাইন মর্নিংএ ঘুম ভেঙে দেখা যায় সেতু তৈরি। সেটার যাবতীয় টেস্ট বা নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বেলায় কোনো ছাড় নেই। কারণ এসব দেশে মানুষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের তো তা নয়। আমরা কথায় কথায় মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বলি বটে আমাদের চোখ ইট কাঠ সুরকি রড আর সিমেন্টের দিকে। কতটা সরালে কতটা লাভ কে কাকে কত পার্সেন্ট দিতে পারলো কে কতটা সরাতে পারলো সেটাই এখানে মুখ্য। আজ তার রক্তাক্ত পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছে মানবতা। কলকাতার মানুষদের জন্য সমবেদনা আর প্রার্থনা জানানোর পাশাপাশি আমাদের সাবধানতার দিকটাও দেখা দরকার। এমন অজস্র সেতু আছে দেশে। উড়াল পুলের রমরমা চলছে এখন। সাথে ব্যবসাও। চাঁদাবাজি টেন্ডার বা অন্যকিছুর তোড়ে যেন উন্নয়ন ও জীবন ভেসে না যায়।
একটি রক্তাক্ত উড়াল সেতুর গল্প যেন আর কোনোদিনও সত্য না হয়। বিবেকানন্দ আজীবন মানুষকে অগ্রাধিকার দেয়া সন্ন্যাসী। তিনি জীবনে ধর্মের চেয়ে ফুটবল খেলাকে গুরুত্ব দিতেন তার নামাঙ্কিত দু নাম্বারী সেতু বাঙালির লজ্জা। এমন লজ্জা যেন আমাদের পোহাতে না হয়। মানবিক দিকটা কি একবারও ভাবনায় আসবে না?
লেখক :সিডনি থেকে,
[সংকলিত]