আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ।। খোলা বাজার২৪, বুধবার, ১৮ মে ২০১৬: ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। একটার পর একটা চক্রান্ত। এটা যেন দ্রৌপদীর শাড়ি। যতই টানো, তার আর শেষ নেই। এই সেদিন প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আইয়ের এক এজেন্টকে ঘুষ দিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে তথ্য ক্রয় ও তাঁকে অপহরণের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। দুই দিন না যেতেই গত রবিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আসলাম চৌধুরীকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ইসরায়েলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার।
গত ৫ মে দৈনিক ইত্তেফাক খবর দিয়েছে, গত মার্চ মাসে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির একজন শীর্ষ নেতা মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে দিল্লি, লন্ডন ও কলকাতায় একাধিক বৈঠক করেছেন আসলাম চৌধুরী। তিনি বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব। এসব বৈঠকে একটি ইসলামী দলের (সম্ভবত জামায়াত) শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও বাংলাদেশে মোসাদের এজেন্ট হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। এমন একটি বৈঠকের ছবি ইত্তেফাক প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি ধৃত প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান যেমন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন উপদেষ্টা, তেমনি আসলাম চৌধুরীও বর্তমানে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামে। সদ্য প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর তিনি ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন। অর্থাৎ দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে, দুটিতেই বিএনপির শীর্ষ নেতা জড়িত। সঙ্গে জামায়াতও আছে। এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে, দেশদ্রোহিতা ও সরকারবিরোধিতার চক্রান্ত আর দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা আন্তর্জাতিক চেহারা ধারণ করেছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর প্রাণদণ্ড কার্যকর হওয়ায় পাকিস্তান ও তুরস্ক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে বুঝতে বাকি থাকে না, বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তের জাল কতটা বিস্তার লাভ করেছে।
আসলাম চৌধুরীর কার্যকলাপ সম্পর্কে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল এই বলে সাফাই গেয়েছেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই দেখা-সাক্ষাতে গিয়েছিলেন। তাই যদি হবে তাহলে দলের যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এত বড় অভিযোগ ওঠার পর দল থেকে তাঁর সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন? শফিক রেহমানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সরকারের চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দিয়ে বিএনপি নেত্রী তাঁর মুক্তি দাবি করেছেন। আসলাম চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তিনি কি তাই করবেন? যদি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তাঁর সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের (যে ষড়যন্ত্রে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানও জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে) চক্রান্তটি সফল না হতো এবং জিয়াউর রহমানসহ চক্রান্তকারীরা ধরা পড়তেন, তাহলেও কি প্রচার চালানো হতো যে এটা সরকারি চক্রান্ত ও অপপ্রচার?
পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সময়ও এই অপপ্রচার চালানো হয়েছে। যে হামলায় শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারত (বস্তুত হামলাটিও সেই উদ্দেশ্যেই চালানো হয়েছিল), সে সম্পর্কে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার শীর্ষ উপদেষ্টা শফিক রেহমান লিখেছিলেন, এই গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগই চালিয়েছে। এভাবে শেখ হাসিনা ভিকটিম সেজে জনসাধারণের কাছ থেকে সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে চান। বলা বাহুল্য, যে তারিখটিতে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর শিশুপুত্র, সদ্য বিবাহিত পুত্রবধূদ্বয়সহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, সে তারিখটিকে যদি বিএনপি নেত্রী তাঁর বানানো জন্মদিন হিসেবে পালনের চরম হৃদয়হীনতা দেখাতে পারেন, তাহলে পরবর্তীকালে তাঁর এক শীর্ষ উপদেষ্টা শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা নিয়ে তামাশা করবেন, তাতে বিস্ময়ের কী আছে?
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতির হোতা ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর দলটি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পরিহার করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসবে—এটাই আশা করা গিয়েছিল। খালেদা জিয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যান এবং আওয়ামী লীগ ও জনগণের দাবি মেনে নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যান। স্বৈরাচারবিরোধী (এরশাদ) আন্দোলনেও তিনি রাজপথে জনতার কাতারে নেমে এসেছিলেন। আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশে সুস্থ দ্বিদলীয় গণতন্ত্র চালু হবে।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেশের মানুষের এই আশা ভঙ্গ হয়। খালেদা জিয়া ‘মাদাম জেনারেল জিয়া’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে বসে আবার তিনি ক্যান্টনমেন্টের রাজনীতি শুরু করেন। ক্ষমতায় বসে ও ক্ষমতার বাইরে থেকেও কিভাবে ষড়যন্ত্রের ভয়াবহ কলকাঠি নাড়ানো যায়, বিএনপি তার যে নজির সৃষ্টি করেছে তার কোনো তুলনা নেই। যত দিন খালেদা জিয়া দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নেতাদের পরামর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন, তত দিন মনে হয়েছে ধীরে ধীরে বিএনপি শুধু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হওয়া নয়, একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবেও তার রূপান্তর ঘটতে চলেছে। তাই তার জনসমর্থনও বেড়েছিল।এই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে তারেক রহমান লায়েক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। বাবার চেয়েও চরিত্রে কুটিল ও নিষ্ঠুর এই যুবক দলের প্রবীণ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল নেতাদের বড় অংশকেই দল থেকে বিতাড়ন করেন অথবা দলে কোণঠাসা করে ফেলেন। জামায়াতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা চক্র আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত হাওয়া ভবন দেশে সব ধরনের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির হেডকোয়ার্টার হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে হত্যার জন্য শ্রীলঙ্কার জঙ্গিগোষ্ঠী তামিল টাইগারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। শ্রীলঙ্কার ‘দি নিউজ’ পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ড সফল করার জন্য তামিল টাইগারকে ১০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার চুক্তি হয়। ১৯৯৯ সালের এই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ বহু নেতাকে হত্যা করা সম্ভব হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্র অবৈধভাবে দেশে আনার চেষ্টার পেছনেও ছিল বাংলাদেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করা। শেখ হাসিনার সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনেও ছিল আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা। এই হত্যার রাজনীতির পাশাপাশি জামায়াতের রগকাটা, শিরকাটার সন্ত্রাস তো চলছিলই। বাংলাভাই ও শায়খ আবদুর রহমানদের মতো সন্ত্রাসীদের আবির্ভাব ছিল জামায়াতের রাজনীতিরই গোপন পরিকল্পনার অংশ।
আর এসব কিছুর পেছনেই তারেক রহমানের ‘অলস মস্তিষ্কে’র অশুভ চিন্তাভাবনা কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা এবং বিভিন্ন বড় দাগের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলায় তিনি অভিযুক্তও। তিনি অসুস্থতার অজুহাতে দীর্ঘকাল বিদেশে বাস করে এসব মামলার বিচার এড়াচ্ছেন, কিন্তু একই সঙ্গে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, জয় অপহরণ ষড়যন্ত্র, মোসাদ ও আইএসআইয়ের সাহায্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এখন উঠেছে এর সব কিছুর পেছনেই ‘ব্রেন’ হিসেবে কাজ করছেন তারেক রহমান। জয় সংক্রান্ত ষড়যন্ত্রে এফবি আইয়ের এজেন্টকে ৩০ হাজার ডলার দেওয়ার চুক্তি করা হয়েছিল। যে ব্যক্তির মাধ্যমে এই চক্রান্ত সফল করার চেষ্টা হয়েছিল, সে এখন মার্কিন মুল্লুকে জেলে।
এই যে একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারাবাহিকতা, তা থেকে দেশকে মুক্ত করা না গেলে গণতন্ত্রের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতি বন্ধ করার জন্য যদি সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে (যা গ্রহণ করা প্রয়োজন) তাহলে আমাদের একটি সুধীসমাজ চিৎকার শুরু করে, দেশে রাজনৈতিক নির্যাতন চলছে, মানবাধিকার খর্ব করা হচ্ছে ইত্যাদি। হত্যা ও ষড়যন্ত্র করার রাজনীতি গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত নয়। ডাকাত আসছে জেনেও গৃহস্থ যদি ঘরের দরজা খুলে রেখে ডাকাতের অপেক্ষা করে, তা মানবাধিকার রক্ষা করা নয়। আমেরিকা তার স্বার্থ ও নিরাপত্তার অজুহাতে অন্য দেশে গিয়ে হামলা চালালে তা যদি অন্যায় না হয় তাহলে কোনো দেশ তার নিজের ঘরের মানবতার শত্রুদের বিচার করে শাস্তি দিলে তা অন্যায় হয় কিভাবে?
অন্য দেশ—বিশেষ করে মিত্র মনোভাবাপন্ন নয় এমন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তাবিরোধী ষড়যন্ত্রে কেউ লিপ্ত হলে তা চরম শাস্তিযোগ্য দেশদ্রোহিতার অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। সাম্প্রতিক অভিযোগগুলো সম্পর্কে তাই বিএনপির সতর্ক হওয়া উচিত। চূড়ান্তভাবে ডেথউইশ বা মৃত্যু-ইচ্ছায় না পেয়ে বসলে কোনো দলের পক্ষে অবিরাম ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা সম্ভব নয়।
আমি বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নই। কিন্তু দেশের রাজনীতি থেকে বিএনপি বিলুপ্ত হোক তা চাই না। বরং দলটি সুস্থ ও সঠিক গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসুক এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিকল্প আরেকটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের অভাব পূর্ণ করুক—এটা আমার কামনা। কিন্তু বর্তমানে বিএনপি যে ধরনের অপরাজনীতিতে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে তা সত্য হলে অবশ্যই দলটিকে ডেথউইশ বা মৃত্যু-ইচ্ছায় পেয়ে বসেছে। বিএনপির বর্তমান অবস্থা এই দুঃখজনক অবস্থারই আভাস দেয়।
খালেদা জিয়া অন্ধ সন্তানবাৎসল্য থেকে মুক্ত হোন। জামায়াতের সংস্রব বর্জন করুন। দলের প্রবীণ গণতন্ত্রমনা নেতাদের কাছে টানুন। আবার সক্রিয় করুন। দলের জন্য গণতান্ত্রিক কর্মসূচি তৈরি করুন। নইলে এই ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তাঁর দলের ডেথউইশকেই আজ না হোক কাল বাস্তবায়িত করবে।