Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

21kখোলা বাজার২৪, সোমবার, ১৩ জুন ২০১৬: ভেঙে যাওয়া গাল, পাতলা হয়ে আসা চুল, কালো রোদচশমা পরা, হুইলচেয়ারে বন্দি মোহাম্মদ আলীকে এ প্রজন্ম দেখেছে এভাবেই। কিন্তু কে ছিলেন তিনি? ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে, থাকবে সে কথা। বক্সিং রিংয়ে তাঁর নেমে পড়াটা ছিল অদ্ভুতভাবে। তখন ১২ বছরের। কয়েক দিন ধরেই আহ্লাদে আটখানা ছিলেন ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র ওরফে মোহাম্মদ আলী। আহ্লাদের কারণ, নতুন বাইসাইকেল। ওটা পাওয়ার পর থেকে যেন আর কিছুতেই মন বসছিল না তাঁর। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছিলেন ওই সাইকেল। একদিন বিকেলে ছোট্ট ক্লে সেই সাইকেল নিয়েই বেরিয়েছেন। গন্তব্য কলম্বিয়া অডিটরিয়াম। সেখানে পৌঁছে জায়গামতোই সাইকেল রেখে ভেতরে ঢুকেছিল। কিন্তু অডিটরিয়াম থেকে বেরোনোর পর সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। আরে, কোথায় সাইকেল! কোথায় গেল? কে নিল?
ছোট ক্লে অস্থির। সাইকেল তার চাই-ই। যেভাবেই হোক। ক্লেকে অস্থির দেখে পরিচিত একজন জানাল, অডিটরিয়ামের বেজমেন্টে একজন পুলিশ অফিসার আছেন। তাঁকে গিয়ে জানাও। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করেই ক্লে ছুটে গেল ওই অফিসারের কাছে। ওই বেজমেন্টেই জিম চালাতেন অফিসার জো মার্টিন। অফিসারের সামনে গিয়েও নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেনি ক্লে। পরিষ্কার বলে দেয়, ‘ওই সাইকেল চোরকে হাতের সামনে পেলে মেরে মুখ ফাটিয়ে দিতাম।’ জো মার্টিন ছিলেন একজন বক্সিং প্রশিক্ষকও। ছোট্ট ক্লেকে এত উত্তেজিত দেখে অফিসার মার্টিন ক্লেকে বোঝালেন, চোরকে ধরে মারতে গেলে আগে শিখতে হবে কী করে মারতে হয়। এই একটা পরামর্শ। এই এক মন্তব্য। ঘুরিয়ে দিল ক্লের জীবনের গতি। শুরু ক্লের প্রশিক্ষণ দিয়েই। পরে যিনি বিশ্ব জয় করবেন, তাঁর প্রথম মাস্টারমশাই হয়ে গেলেন জো মার্টিন। সেটা ১৯৫৪ সাল। সে বছরই অপেশাদার বক্সিংয়ে নেমে পড়েন ক্লে।
১৯৬০ রোম অলিম্পিকে সোনা জেতেন ক্যাসিয়াস। ১৯৬০ সালেই পেশাদার বক্সিংয়ে এসেছিলেন ক্লে। তার আগে অপেশাদার রিংয়ে লড়েছেন ১০৫টি ম্যাচ। জিতেছেন ১০০টিতে।
১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ১৯টি ম্যাচের ১৯টিতেই জয়। তার মধ্যে ১৫টি নক আউট করে। তাক লাগানোর মতো রেকর্ড। যোগ্যতা অর্জন করে ফেললেন বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনের মুখোমুখি হওয়ার। অবশেষে সেই দিন! ১৯৬৪ সালের ২৫ ফেরুয়ারি। মিয়ামির রিংয়ে নামার আগে বিশ্ব আর এক ক্লেকে দেখল। যাঁর আস্ফাালন বিপক্ষকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। ক্লে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘সনি একটা বিশাল, কুিসত ভালুক। বিশ্রী গন্ধ। ওকে হারানোর পর চিড়িয়াখানায় রেখে আসব।’ তাঁর আস্ফাালন অমূলক প্রমাণিত হয়নি। সনিকে হারিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। এ বছরই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ক্লে। নাম বদলে হন মোহাম্মদ আলী।
বক্সিং রিংই তাঁকে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি দিয়েছে। দিনের পর দিন লড়াই করেছেন নিজেকে সেরা করে তোলার জন্য, নিজেকে সেরা জায়গাটায় টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু আত্মসম্মানের যুদ্ধে তিনি হেলায় ছেড়ে আসতে পেরেছেন এ সবকিছু। এখানেই আরো অনেক ক্রীড়াবিদের থেকে মোহাম্মদ আলী স্বতন্ত্র। ভিয়েতনামে বোমা ফেলছে আমেরিকা। ডাক এলো মোহাম্মদ আলীরও। যেতে হবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। বাধ্যতামূলক। রুখে দাঁড়ালেন আলী। না, যাব না এবং গেলেন না। এর জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছিল মোহাম্মদ আলীকে। যে বক্সিং তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, সেই বক্সিং রিং থেকে নির্বাসিত হলেন। ১৯৬৭-এর মার্চ থেকে ২৫ বছরের আলীকে আর রিংয়ে নামতে দেওয়া হলো না। সেই নিষেধাজ্ঞা উঠল মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর। সেটা ১৯৭১ সাল।
নিষেধাজ্ঞা যখন উঠল, ২৯ বছর বয়স হয়ে গেছে মোহাম্মদ আলীর। চার বছর রিংয়ের বাইরে। ইতিমধ্যেই বক্সিং সার্কিটে এসে গেছেন তরুণ প্রজন্মের বক্সাররা। বয়স কম। ক্ষিপ্রতা বেশি। কিন্তু এসব তোয়াক্কা করেননি আলী। তিনি যে মোহাম্মদ আলী। আর কেউ তখনো জানুক না জানুক, তিনি তো জানেন কী করতে হবে তাঁকে! আবার শুরু হলো লড়াই। একের পর এক প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করছেন। এর মধ্যেই জো ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে সেই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, যে ম্যাচ বক্সিংয়ের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি হলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যানের। ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪ খেতাব পুনরুদ্ধার করলেন আলী। ৩২ বছর বয়সে ২৫ বছর বয়সী ফোরম্যানকে হারিয়ে। ইতিহাস গড়লেন।
১৯৮১ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত পেশাদার রিংয়ে নেমেছেন ৬১ বার। ৫৬ বার জিতেছেন। আর জীবনের লড়াইয়ে? সম্মানের লড়াইয়ে? সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে দেখে নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়েছিল সেসব পুরনো দিনের কথা। আর বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েই স্মরণ করেছিলেন মোহাম্মদ আলীকে। ওবামার জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা যে তিনি। ৭৪ বছর বয়সে এই মানুষটিই সারা পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করে চলে গেলেন।
বক্সিয়ের কিংবদন্তি আলী আজ নেই। আমেরিকার ফিনিক্সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট’। লুইভিল। যে শহর তাঁকে জন্মাতে দেখেছে। যে শহর তাঁর ছটফটানি দেখেছে। যে শহর তাঁর জীবনের গতি বদলাতে দেখেছে। যে শহর সাক্ষী থেকেছে তাঁর সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনীর। সেই লুইভিলেই চিরকালের মতো শায়িত থাকবেন মোহাম্মদ আলী।
‘দ্য গ্রেটেস্ট’কে আর ধরে রাখা যাবে না, চিকিৎসকরা জানিয়ে দেওয়ার পরই পরিবারের তরফে লুইভিলে শুরু হয়ে গিয়েছিল শেষ শয্যার প্রস্তুতি। মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে ইতিমধ্যেই লুইভিলে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। পারিবারিক মুখপাত্র বব গানেল জানিয়েছেন, সারা বিশ্বের মানুষের ভালোবাসা, প্রার্থনা, আন্তরিকতায় আপ্লুত আলীর পরিবার। কঠিন সময়ে যেভাবে সবাই পাশে থাকছেন, তার জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছে তারা।
কোথায় হবে তাঁর শেষকৃত্য, কে কে থাকবেন, কিভাবে দুনিয়াকে শেষ বিদায় জানাবেন—প্রতিটি খুঁটিনাটি ছক করে রেখেছিলেন। ঠিক গেম প্ল্যানিংয়ের মতোই। এসব জানিয়ে রাখার জন্য শেষ কয়েক বছর বারবার তাঁর ঘনিষ্ঠদের তলব করতেন। মৃত্যুর দু-এক দিন আগেও নাকি আলোচনায় বসেছিলেন মোহাম্মদ আলী। তাঁকে এ বিষয়ে সাহায্য করতেন ইসলাম গবেষক টিমোথি জিয়ানোট্টি। আলীর সেসব নির্দেশ লিখে রাখতেন ঘনিষ্ঠরা, যা এখন বইয়ের আকার নিয়েছে। নাম ‘দ্য বুক’। টিমোথি জানিয়েছেন, আলী চাইতেন শুধু ভিভিআইপি নয়, ভক্তরাও তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকবেন। স্মরণসভা হবে কোনো স্টেডিয়ামে, যাতে অনেক মানুষ যোগ দিতে পারে। সেই ইচ্ছা মেনেই বৃহস্পতিবার দুপুরে লুইভিলের ফ্রিডম হলে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। ১৯৬০ সালে এই হলেই আলী প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন এবং জিতেছিলেন। সেখানেই মুসলিম রীতি মেনে জানাজা পড়া হবে। তবে শুধু মুসলিম নয়, আলী চেয়েছিলেন তাঁর শেষকৃত্যে সব ধর্মের সমন্বয় ঘটুক। তাই খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি ধর্মের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য দেবেন। এরপর লুইভিলের যেসব গলিতে আলী খেলে, সাইকেল চালিয়ে বড় হয়েছেন, সেখান দিয়ে যাবে শবযাত্রা। সবশেষে সমাহিত করা হবে কেভহিল সমাধিস্থলে।
লুইভিলে আলীর ছোটবেলার বাড়িটিকে এখন মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছে, সেই বাড়ির সামনে, আলীর ছবির সামনে স্তূপীকৃত ফুলের তোড়া ও হাজারো কার্ড, যাতে লেখা ভক্তদের বিভিন্ন বার্তা। তাঁর শবাধার বহন করবেন অনেক সেলিব্রিটি, যাঁর অন্যতম হলেন উইল স্মিথ। আলীর ভূমিকায় অভিনয় করে অস্কার নমিনেশন পেয়েছিলেন উইল স্মিথ। আলীর প্রতি ফেসবুকে এক বার্তায় উইল স্মিথ শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি আমার পৃথিবীটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলেন। আপনি আমার পথপ্রদর্শক, আপনি আমার বন্ধু। আমার জীবন বদলে দিয়েছিলেন আপনিই। আপনার আত্মার শান্তি হোক।’
আলীর আত্মার প্রতি এই শান্তি কামনা আজ বিশ্বজুড়েই।
টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে গাউস রহমান পিয়াস