আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ।। খোলা বাজার২৪,শনিবার, ১৮ জুন ২০১৬: সন্ত্রাস দমনে সাঁড়াশি অভিযান পুরোদমে চলছে। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য। অনেকে বলছেন, এই অভিযান ঘোষণা দিয়ে শুরু করা ঠিক হয়নি। তাতে আসল সন্ত্রাসীরা আগেই সাবধান হয়ে আত্মগোপনের সুযোগ খুঁজবে। অতীতেও এ ধরনের অভিযানে এটা ঘটতে দেখা গেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, পাইকারি গ্রেপ্তারের একটা মন্দ দিক হলো, পুলিশি অভিযানে অনেক নির্দোষ লোকও অযথা হয়রানি পোহায়। পুলিশ এবারও সম্ভবত চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে। এই চিরুনির ফাঁক দিয়ে আসল দোষী যাতে পালাতে না পারে এবং নির্দোষ লোক কষ্ট না পায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
আরো একটি বিষয় এ অভিযানে লক্ষ রাখতে হবে। সেটি হলো আমাদের পুলিশ বাহিনীর সুনাম। কেউ যেন বলতে না পারে, ঘাতক ধরার অভিযান চালানোর সুযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার বাণিজ্য শুরু করেছে। বিএনপি-জামায়াত, এমনকি আমাদের একটি তর্কবাগীশ সুধীসমাজের কাছ থেকেও এ অভিযোগ উঠতে পারে। পুলিশ কর্তৃপক্ষকে এবার এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে ৫৬ হাজার ঘাতক, দালাল ও কোলাবরেটর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, কোলাবরেশনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের ছাড়া আর সবাইকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় বঙ্গবন্ধুর সরকার মুক্তি দিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত এখনো প্রচারণা চালায়, বঙ্গবন্ধু এই যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কথাটা সত্য নয়।
সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাটি যেদিন তৈরি হয়, সেদিন আমি পুরনো গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছেই ছিলাম। কোলাবরেশন আইনে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হাজার হাজার ব্যক্তি ছিল সন্দেহভাজন। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তখনো পুলিশ তৈরি করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু এই হাজার হাজার সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে হয়রানির হাত থেকে মুক্ত করে অসংখ্য পরিবারকে ধ্বংস হতে দেননি। আসল কোলাবরেটরদের তিনি ক্ষমা ঘোষণার আওতায় আনেননি।
এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আরো একটি নেপথ্যের কারণ ছিল, যে কারণটির কথা বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছের লোকও পরে প্রকাশ করেননি। কেন করেননি তা আমার জানা নেই। একাত্তরের কোলাবরেটর গ্রেপ্তার অভিযানের সময় বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ আসতে থাকে—বিভিন্ন জেলায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত এক শ্রেণির নেতাকর্মী জমিজমা, সম্পত্তিঘটিত বিবাদে প্রতিপক্ষকে কোলাবরেটর সাজিয়ে পুলিশের কাছে নাম দিচ্ছে এবং পুলিশকে প্রভাবিত করে তাদের গ্রেপ্তার করাচ্ছে।
অন্যদিকে এক শ্রেণির পুলিশ অফিসারও “োর গ্রেপ্তার বাণিজ্য শুরু করেছেন বলে অভিযোগ আসতে শুরু করে। যারা কোলাবরেটর নয়, এমন ব্যক্তিদেরও টাকা না দিলে কোলাবরেটর হিসেবে গ্রেপ্তার করা হবে—এই ভয় দেখানো শুরু হয়েছিল এবং অসাধু পুলিশ অফিসাররা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সাধারণ মানুষকে এই হয়রানি থেকেও মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন।
বর্তমানের সন্ত্রাস দমনের সাঁড়াশি অভিযানেও বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ রাখতে হবে, বর্বর ঘাতকদের দমনে এ অভিযান যত প্রয়োজনীয়ই হোক না কেন, কোনো কারণেই সাধারণ ও নির্দোষ নাগরিকরা যেন জেল-জুলুমের শিকার না হয়। বর্তমান পুলিশ বাহিনীর সুনামে কেউ যেন কর্দম ছিটাতে না পারে। বাংলাদেশের বর্তমান পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, হাসিনা সরকারের আমলে এই বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলেও এ বাহিনীর মধ্যে আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল তরুণ, দক্ষ, সৎ অফিসার তৈরি হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের তরুণ পুলিশ সুপারের নামও করতে হয়, যাঁর স্ত্রীকে এই সেদিন নরপশু ঘাতকের দল হত্যা করেছে। দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই এসপি বাবুল আক্তারকে এই নিদারুণ পারিবারিক বিপর্যয় সহ্য করতে হলো।
এ ধরনের বহু সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মী ও অফিসার এখন পুলিশ বাহিনীতে আছেন। সরকারের উচিত তাঁদের উৎসাহিত ও পুরস্কৃত করা। বর্তমান সাঁড়াশি অভিযান যাতে স্পষ্টভাবে পরিচালিত হয় এবং পুলিশের ঘাড়ে কোনো দুর্নাম না চাপে, সে জন্য সরকারের উচিত বাছাই করা সৎ ও দক্ষ তরুণ পুলিশ অফিসারদের দ্বারা একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম তৈরি করা, যে টিম এই অভিযান পর্যবেক্ষণ করবে এবং মাঠের পুলিশকে গাইডলাইন দেবে।
এই সন্ত্রাস দমন অভিযানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতাকর্মী যাতে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রান করার সুযোগ না পায়, সেদিকেও সরকারকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, অভিযান শুরু হওয়ার ঘোষণা শুনেই বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরছাড়া হয়েছে, আত্মগোপন করেছে। তাদের ভয়, সন্ত্রাসী ধরার নামে তাদের ধরা হবে। সুযোগ বুঝে বিএনপির কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা এই প্রচারণা চালাচ্ছেন যে সরকার সন্ত্রাস দমনের নামে বিরোধী পক্ষকেই দমনের নীতি গ্রহণ করেছে।
সরকারকে সর্বপ্রথমে এই প্রচারণা যে মিথ্যা তা প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির কোনো নেতা বা কর্মী সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে তাদের যে ভয় নেই, আর সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত থাকলে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা কর্মীকেও রেহাই দেওয়া হবে না—এই সত্যটি এবারের অভিযানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। নইলে পাইকারি গ্রেপ্তারে এবং বিপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীদের মাঠশূন্য করার আড়ালে গলা কাটার নরপশুরা আত্মগোপনের সুযোগ পাবে এবং সাঁড়াশি অভিযানে পাঁচ হাজার কেন, পাঁচ লাখ লোক ধরা হলেও অভিযান সফল হবে না। কিছুদিনের জন্য সন্ত্রাসীরা আত্মগোপন করবে, এরপর আবার বেরিয়ে আসবে।
এই সন্ত্রাস দমনে পুলিশি অভিযানের সঙ্গে একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক উদ্যোগেরও প্রয়োজন। বিএনপি নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে সাধারণ কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব পাওয়া যায় না। এবার দলটির অন্যতম নেতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের কাছ থেকে একটি গঠনমূলক প্রস্তাব পাওয়া গেছে। তিনি সন্ত্রাস দমনের জন্য জাতীয় সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, সন্ত্রাস দমন একটি জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের পন্থা নির্ণয়ের জন্য সব দল নিয়ে সরকারের বসা উচিত।
প্রস্তাবটি ইতিবাচক। বর্তমানে সন্ত্রাস দমনের চেয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে চলছে পরস্পরকে দোষারোপের পালা। আওয়ামী লীগ বলছে, এই সন্ত্রাসের পেছনে যোগ রয়েছে বিএনপির। আর বিএনপি বলছে, এই হত্যা, গুম—সব কিছুই আওয়ামী লীগের কারসাজি। তারা বিরোধী দলকে নির্মূল করতে চায়। এই পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যে আইএসের সাইনবোর্ডের আড়ালে একদল জঙ্গি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দিনের পর দিন ঘটিয়ে চলেছে। সন্দেহ নেই, আইএসের নাম ব্যবহার করে এর পেছনে জামায়াত-শিবির, জেএমবি, আনসার আল-ইসলাম ইত্যাদি সন্ত্রাসী সংগঠনের পলাতক ক্যাডাররা রয়েছে।
শুধু প্রশাসনিক শক্তি দ্বারা অনেক সময় সন্ত্রাস দমন করা যায় না। সে জন্য রাজনৈতিক ঐক্য ও উদ্যোগ দরকার। প্রশাসনিক শক্তি দ্বারা সন্ত্রাস নির্মূল করা গেলে গত সোমবার আমেরিকার অরলান্ডোতে এত বড় সন্ত্রাসী হামলা ঘটতে পারত না। একটি নৈশক্লাবে এ হামলায় ৫০ জনের মতো লোক মারা গেছে বলে প্রাথমিক খবরে জানা গেছে। এ হামলার দায়িত্বও গ্রহণ করেছে আইএস। বাংলাদেশ সম্পর্কে আমেরিকার অভিযোগ, দেশের সরকার সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ। ভাগ্যের কী পরিহাস, এখন সেই আমেরিকায়ই আরো বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে এক বছরের বেশি সময়ে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে ৪৯ জনকে। আর আমেরিকায় এক রাতেই হত্যা করেছে ৫০ জনকে। ব্যর্থতাটা কোন সরকারের বড়—বাংলাদেশের, না আমেরিকার?
সে যা-ই হোক, বাংলাদেশে এই টার্গেটেড কিলিংয়ের বর্বরতা বন্ধ করা প্রয়োজন। দেশের জনজীবন আতঙ্কগ্রস্ত। এই আতঙ্ক দূর করার জন্য সরকার সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। এর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের কথা সরকার ভেবে দেখতে পারে। এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতীয় পর্যায়ে সংলাপের প্রয়োজন। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীসমাজের প্রতিনিধিসহ সরকার একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করতে পারে, যে বৈঠকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও অংশ নেবেন।
বর্তমান সময়ে যেকোনো উপায়ে এই নরপশুদের দমনই সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।