Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

20kএ এম এম শওকত আলী । । খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০১৬:
জঙ্গি শব্দটি বর্তমানে বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশে জঙ্গি কতজন সে বিষয়ে পুলিশ তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য সৃষ্ট তথ্যভাণ্ডারভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা হবে। সরকারও অভিমত ব্যক্ত করেছে যে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করা হবে। শূন্য সহনশীলতা শব্দটি ২০০৯ সালেও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে শোনা গিয়েছিল। বর্তমানে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে এ বিষয়টি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী দৃশ্যমান। একদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অন্যদিকে জঙ্গি দমনের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বিতর্কও হচ্ছে। অতীতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানসংক্রান্ত বিতর্কের প্রধান বিষয় ছিল ২০০১-২০০৬ সালের ক্ষমতাসীন সরকারের কিছু ব্যক্তির জঙ্গি সমর্থক হওয়ার তথ্য। যেমন জেএমবির প্রধান নেতা বাংলা ভাইয়ের অস্তিত্বের কথা ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সরকারের এক মন্ত্রীর অস্বীকারের বিষয়। বর্তমান সময়ে এ ধরনের অভিযোগ শোনা না গেলেও জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে কয়েক হাজার সন্দেহভাজন জঙ্গির গ্রেপ্তার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।

কিছুদিন আগে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অভিজিৎ হত্যা মামলার আসামি শনাক্ত করা হয়েছে এবং শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে। শেষ পর্যন্ত ২১ জুন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল যে পুলিশ কর্তৃক চিহ্নিত অভিজিতের হত্যাকারী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তাকে শরিফুল নামে অভিহিত করা হয়। তবে তার আসল নাম মুকুল রানা বলে পরিবারসূত্র থেকে বলা হয়েছে। এ কথাও জানা গেছে যে প্রায় চার মাস আগে ‘শরিফুল’ ওরফে মুকুল রানা যশোরের বসুন্দিয়া থেকে নিখোঁজ হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরিও লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর সে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে খিলগাঁওয়ে নিহত হয়। নামের বিভ্রাট সম্পর্কে পুলিশের বক্তব্য হলো নাম যাই হোক নিহত মুকুল রানাই অভিজিতের মূল হত্যাকারী। প্রশ্ন ওঠে যে নিহত ‘জঙ্গি’র আসল নাম পুলিশ কিভাবে জানতে ব্যর্থ হলো।
পুলিশ সূত্র থেকে নিহত মুকুল রানার একাধিক নাম ছিল বলে জানা গেছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী শরিফুল ছাড়াও তার নাম ছিল শাকিব, সালেহ, আরিফ ও সাদি। যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের ব্যক্তির নাম গোপন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন বা শনাক্তকৃত অপরাধীর আসল নাম তদন্তে চিহ্নিত করা যাবে না, বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমে যখন জঙ্গিবিরোধী অভিযানবিষয়ক একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন যে অভিজিৎ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে, তাহলে কি ধরে নিতে হবে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত না করেই এ কথা বলা হয়েছে? কোথাও কি একটি ভুল ছিল? উল্লেখ্য, নিহত যুবক শরিফুল তথা মুকুল রানা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গি ছিল। এ ঘোষণায় কি জীবিত অথবা মৃত বলা হয়েছিল? এ নিয়ে আরো তথ্য বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের বা কথিত অপরাধীদের বছরওয়ারি পরিসংখ্যান পুলিশের পক্ষ থেকে সামষ্টিকভাবে কখনো প্রকাশ করা হয়নি।
তবে ২০ জুন ও পরে একাধিক দৈনিকে এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। ২০ জুন ক্রসফায়ার বা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২০০৪ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে, অর্থাৎ গত ১২ বছরে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা হলো এক হাজার ৭১৫। ২০ জুন একটি দৈনিকে এ পরিসংখ্যান প্রধান সংবাদ হিসেবে দৃশ্যমান ছিল। প্রদত্ত লেখচিত্রের অন্য মন্তব্য ছিল, ‘২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধ কমলেও গুমের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময়ে ২৯১ জন নিখোঁজ হন।’ একই দিন অর্থাৎ ২০ জুন অন্য একটি দৈনিকের প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল “পরিকল্পনাকারীরা অক্ষত, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৩ রাতে নিহত ১৯ জনের মধ্যে সাতজন জঙ্গি।” বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঘটনাপ্রবাহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। একটি দৈনিকে তিনজন বিশেষজ্ঞ এ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য সুখকর বা স্বস্তিদায়ক নয়। বর্তমান সরকারের একজন সাবেক আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘এভাবে বন্দুকযুদ্ধ প্রশ্ন ও অবিশ্বাস তৈরি করছে।’ অন্য একজন বলেছেন, ‘রাষ্ট্র নিজেই বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন।’ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরে জঙ্গিবাদের আশ্রয়দাতা।’
ক্রসফায়ার বা অপরাধীদের গ্রেপ্তার অভিযানে বন্দুকযুদ্ধ শব্দ দুটির অন্য নাম এনকাউন্টার। এ শব্দটি এ দেশে খুব একটা ব্যবহার হয় না। ভারতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অতিসম্প্রতি মাদারীপুরে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া একজন কথিত অপরাধী ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এ নিয়েও মিডিয়ায় কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বিষয়টি পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা। একজন বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলেছেন, এ ঘটনার তদন্ত হওয়া জরুরি। এ মন্তব্য আইনসিদ্ধ, ফৌজদারি কার্যবিধিতে পুলিশি হেফাজতে কোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে পুলিশের তদন্ত ছাড়াও একজন উপযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা তদন্ত করানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একটি দৈনিকে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও এখন পর্যন্ত তদন্তের বিষয়ে কোনো সরকারি সিদ্ধান্তের খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি সংসদীয় আলোচনায়ও এ বিষয়টি আসেনি। যা এসেছে তা হলো, ক্রসফায়ার জঙ্গি নির্মূলের কোনো সমাধান নয়।
বরং এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থার হেফাজতে থাকা জঙ্গি বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধীর মৃত্যুর বিষয়টি স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ধরে নেওয়া যায় না। এ জন্য ফৌজদারি কার্যবিধিতে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অনুসন্ধান বা তদন্তের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের তদন্তের অন্যতম লক্ষ্য হলো কী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। অতীতেও ও বর্তমানেও পুলিশের পক্ষ থেকে শোনা গেছে যে পুলিশ যদি আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে তা বে আইনি নয়; বরং আইনসিদ্ধ। অন্যদিকে এ কথাও শোনা যায় যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির সুরক্ষা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কর্তব্যরত পুলিশের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। বিশেষ করে পুলিশি হেফাজতে থাকা যেকোনো ব্যক্তির। অন্যথায় বিচারব্যবস্থা রাখার কোনো অর্থ হয় না। পুলিশের গুলিতে কোনো অপরাধী বিশেষ করে হেফাজতে থাকা অপরাধীর মৃত্যু হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য বাধা সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী সময়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র বা বল প্রয়োগ করার বিষয়টি আমাদের দণ্ডবিধিতে স্বীকৃত। তবে এ অধিকারও সংশ্লিষ্ট আইনি ধারায় অনিয়ন্ত্রিত নয়। এ ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ন্ত্রণ হলো গুলি অথবা অন্য ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে, যার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ লাগামহীন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। এ বিষয়টি একমাত্র নিরপেক্ষ তদন্তই সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবে। যেকোনো বন্দুকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধি ছাড়াও প্রতি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমূলক আইন রয়েছে। এসব আইন ও যেসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধি প্রযোজ্য তা যদি একেবারেই কার্যকর করা না হয়, তাহলে আইনের শাসন ব্যাহত হয়। এ কারণেই মানবাধিকার ও অন্যান্য সরকারবহির্ভূত সংগঠন কথিত ক্রসফায়ারে অপরাধীদের মৃত্যুর ঘটনার উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেকটা একই ধরনের মন্তব্য-বক্তব্য। ২৫ জুন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সরকারের ‘অস্বচ্ছ’ পদক্ষেপসংক্রান্ত বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করেছে। এ সংস্থার প্রতিনিধি বলেছেন যে ব্লগার ও লেখকদের হত্যার বিষয়ে সরকারকে অধিকতর সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করতে হবে।
একদিকে একের পর এক গুপ্তহত্যা, অন্যদিকে সন্দেহভাজন অপরাধীদের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু। পুলিশের গুলি করার বিষয়ে বলা যায় যে ৩০ বা ৪০ বছর আগে গুরুতর অপরাধীদের হাতে অস্ত্র থাকত না। এখন তারা নির্বিচারে এটা ব্যবহার করছে। বোমাসহ বিস্ফোরক দ্রব্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০১ সাল-পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ আরো কিছু জেলায় সিরিজ বোমা ব্যবহার করা হয়। কিছু আসামি ধরাও হয়েছিল। এর পরও এদের মূল উৎস কী তা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। বিতর্ক শুধু আইএস বাংলাদেশে আছে কি নেই। প্রথমে আফগানি তালেবানদের উত্থান, পরে বাংলা ভাই। এখন নিষিদ্ধসহ কিছু জঙ্গি সংগঠন। এর মধ্যে কিছু নতুন নামধারী সংগঠন। এ কথাও সঠিক যে নীরবে অথবা সরবে অপরাধ দমনে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। এর কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যও ২৫ জুন পত্রিকায় পাওয়া গেছে। তিনজন বিদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের এসপির স্ত্রীর হত্যা ঘটনার ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জঙ্গি হিসেবে এখনো চিহ্নিত করা হয়নি। হয়তো বা গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। পুলিশের করণীয় হবে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা রোধ করে বিচারের পথ প্রশস্ত করা। তাহলেই তারা জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। তবে চট্টগ্রামের এসপির স্ত্রী হত্যা ঘটনার সর্বশেষ খবর হলো, এসপি বাবুল আক্তার এখন পুলিশি হেফাজতে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর মানে কী? অবশ্যই আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা