এ এম এম শওকত আলী । খোলা বাজার২৪, সোমবার, ২৫ জুলাই ২০১৬: গুলশান ও পরবর্তী সময় শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর থেকেই জঙ্গি দমনের অনুসৃত কৌশল নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এর আগে আলোচনার মূল বিষয় ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা। তবে অহিংস অবস্থান কর্মসূচিও এর মধ্যে ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ২০০৯ সাল পরবর্তীকালে নির্বাচিত সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট হরতালের মধ্যে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছিল। ব্যতিক্রমধর্মী অহিংস অবস্থান কর্মসূচি পালনের অন্যতম ঘটনা ছিল হেফাজত পরিচালিত মতিঝিলে অবস্থান কর্মসূচি। এতে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনো কথা বলা বা তথ্য পাওয়া যায়নি। এর উদ্দেশ্য ছিল সরকারসহ জনজীবন অচল করে দেওয়া। শেষ পর্যন্ত এ লক্ষ্য সরকার দৃঢ়ভাবে ব্যর্থ করে দেয়।
এর আগেও ১৯৯০ দশকের শেষার্ধ থেকে আফগানফেরত কিছু তালেবানপন্থী ব্যক্তি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটিয়েছিল। ওই সময় থেকেই দেশ ও সমাজসহ সরকারের জন্য এ ছিল ঘুম ভাঙার প্রথম ঘণ্টাধ্বনি। ওই সময়ের পর থেকেই একটি শক্তিশালী বিদেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহনশীল মুসলিম রাষ্ট্র বলে অভিহিত করে। ২০০০ সাল-পরবর্তী সময় বিভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল। এদের নেতারা অনেকেই বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। ওই সময়ে জঙ্গি নেতা বাংলা ভাইয়ের অস্তিত্ব একজন ক্ষমতাসীন অস্বীকার করেন, যা নিয়ে মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রমাণসহ তথ্য প্রকাশ করা হয়। এরপর আসে ইসলামসহ অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে আক্রমণ। প্রথমে বৌদ্ধ মন্দির, পরে শিয়া মসজিদ আক্রমণের শিকার হয়। এরপর বিদেশি নাগরিকদের হত্যা যোগ করে এসব ঘটনাপ্রবাহে নতুন মাত্রা। ২০০১ সাল-পরবর্তী সময় থেকেই জঙ্গি দমনের কৌশল হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নতুন ইউনিট গঠনের চিন্তা শুরু হয়। ইংরেজিতে বলা হয় Counter Terrorism Unit। এর অবস্থান কোথায় হবে তা নিয়ে ওই সময় কিছু বিতর্কও হয়।
দীর্ঘ কয়েক বছর পর জানা যায় যে এ ইউনিট পুলিশ বাহিনীতে হয়েছে। এ বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। চলমান ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে জঙ্গি দমনের সম্পৃক্ততার বিষয়ও দৃশ্যমান হয়। জঙ্গিরা কী সবাই দেশের জঙ্গি, না এদের পেছনে বিদেশি শক্তি রয়েছে। এ প্রশ্নটির এখনো কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বিদেশের সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম আইএস। চলমান বিতর্কে এ নামও এসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে জানা যায় যে বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে এ কথাও বলা হয় যে বিদেশি যোগসূত্র থাকতে পারে। এ বিতর্ক অর্থহীন। কারণ বাস্তবতা হলো, জঙ্গি ঘটনার অবসান এখনো হয়নি। এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই জঙ্গি দমন কর্মকাণ্ড আরো শক্তিশালী ও অর্থবহ করতে হবে।
শুলশানের রেস্তোরাঁর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে ১৬ জুলাই সরকারি সূত্রে শোনা গেছে। ১৭ জুলাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। এ তথ্যের মূল বিষয় হলো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ বিষয়ে কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে। গুলশানের সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞে যে তরুণ জঙ্গিরা অংশগ্রহণ করেছিল তাদেরকেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাট গ্রেপ্তার হওয়া অধ্যাপক ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়মমাফিক পুলিশকে এ তথ্য জানাননি। সাম্প্রতিক জঙ্গি ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম একাধিকবার উচ্চারিত হচ্ছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তদন্ত করছে।
জঙ্গি দমনের ঘটনায় বর্তমানে মিডিয়ায় প্রধানত দুটি বিষয় আলোচিত বা সমালোচিত। একটি দৈনিকে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল জঙ্গি দমনের কর্মকাণ্ডে আইন প্রয়োগের অপমৃত্যু যেন না হয়। এ লেখায় মূলত গুলশানের সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞের ঘটনার বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। আইনের অপমৃত্যুর বিষয়ে বলা হয় যে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের দাবি, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মূল সম্পাদকীয় মন্তব্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়জনিত কার্যক্রমে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা হয়। কারণ একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি দমনের উদ্যোগ গ্রহণে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। প্রকাশিত সম্পাদকীয় মন্তব্যের মূল কথা প্রধানত দুটি। এক. জঙ্গি দমনে যথেষ্ট সমন্বয়ের প্রয়োজন। দুই. যেকোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের উদ্যোগ জঙ্গি দমনের কার্যক্রমে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। জঙ্গি দমনের নামে নির্দোষ ব্যক্তিরা অহেতুক হয়রানির শিকার হতে পারেন। এ ছাড়া বলা হয় যে জঙ্গি দমন একটি জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যার মোকাবিলার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এদের অবশ্যই সরকারবহির্ভূত খাত সহযোগিতা প্রদান করবে। উল্লেখ্য যে এ বিষয়ে পুলিশও সবার সহযোগিতা কামনা করেছে।
এ ধরনের সহযোগিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো মিডিয়াপ্রদত্ত তথ্য। উল্লেখ্য যে কিছু দিন আগে একটি দৈনিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন নামে পরিচিত জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে তথ্যবহুল খবর প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে সাম্প্রতিককালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নিবরাসের ঝিনাইদহে অবস্থান। প্রামাণ্যমূলক এ তথ্য একটি বেসরকারি টিভি সম্প্রচার করে। এর পরই পুলিশ ওই জায়গার কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। পরবর্তী সময় হয়তো আরো অনেক তথ্য জানা যাবে। এই দুটি বিষয় ছাড়াও অন্য যে বিষয়টি মিডিয়ায় আলোচনায় বারবার এসেছে তা হলো, গুম হওয়া তরুণদের তথ্য। এ বিষয়ে অতীতে পুলিশ কোনো গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্র্রতিক সময় গুলশানের রেস্টুরেন্টের হত্যালীলার পর পুলিশ এখন এ বিষয়ে তৎপর। উল্লেখ্য যে এ ক্ষেত্রে অতীতে মিডিয়া বরাবরই তথ্য প্রকাশ করেছিল। গত ১৬ জুলাই কালের কণ্ঠের এক সংবাদে দেখা যায় যে বগুড়া ও নাটোরে নিখোঁজ সন্দেহভাজন ৬৮। এ সংখ্যা যে আরো বৃদ্ধি পাবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে থানায় কেউ গেলে পুলিশ সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করে।
এ বিষয়ে অতীতে পুলিশ তৎপর ছিল না। এখন পুলিশ মাঠে নেমেছে। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা ২৬২, যার মধ্যে তিনজন ফেরত এসেছে। তবে পরিবারের সূত্র অনুযায়ী ১৬ জন। নিখোঁজ ব্যক্তিরা ৩৯টি জেলার। সর্বমোট সাধারণ ডায়েরি হয়েছে ১৭০। ঢাকা থেকে নিখোঁজের সংখ্যা ৫২। ২০১৫ সালে নিখোঁজের সংখ্যা ২৩। ২০১৬ সালে ১২৬। ১১৩ জনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এদের তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত সঠিবভাবে কিছু বলা যাবে না। সক্ষমভাবে কর্মরত ব্যক্তিরাও নিখোঁজ তালিকাভুক্ত। পেশা অনুযায়ী স্বল্পসংখ্যক প্রকৌশলী, ডাক্তার ও পাইলটও রয়েছেন। অন্যান্য পেশার মধ্যে গায়ক, রাজমিস্ত্রি, দোকানের কর্মচারী, গার্মেন্টকর্মী, ডেনটিস্ট ও শিক্ষকও রয়েছেন। এ থেকে এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় যেকোনো একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান জঙ্গিদের উৎস নয়। পত্রিকান্তরে আরো দেখা যায়, নিখোঁজ সব ব্যক্তিই জঙ্গি নয়।
পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়ার পর পরবর্তী সময় কৌশল নির্ধারণে আরো সতর্ক হওয়ার অবকাশ আছে। বর্তমানে অনুসৃত কৌশল কী তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। না হওয়ারই কথা। কারণ কৌশল প্রকাশ করা হলে জঙ্গিরাও পাল্টা কৌশল অবলম্বন করবে। অতীতে মসজিদের মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। জেলা ও উপজেলায় কমিটিও করা হয়। একই উদ্যোগ বর্তমানেও অনুসরণ করা হচ্ছে। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে অতীতের তুলনায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা