Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

amm-showkat-aliএ এম এম শওকত আলী । খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ০৪ আগস্ট ২০১৬: গত কয়েক দিনের সংবাদমাধ্যমে যে বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল ও আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়, তা হলো জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন। চেষ্টা ও অভিযান গতিশীল হচ্ছে। এ সাফল্য দ্বিমুখী। এক. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সফল অভিযান ও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জঙ্গিবাদবিরোধী চেতনার বিকাশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর পর কয়েকটি সফল অভিযান প্রমাণ করেছে যে জঙ্গিদের অবস্থান সম্পর্কে আগাম তথ্য ও পরে গ্রেপ্তারসহ আলামত উদ্ধার করা সম্ভব। কয়েক দিন আগে সিরাজগঞ্জে চার নারী জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে টঙ্গীর ঘটনা। ৮ জুলাই একটি দৈনিকে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের শিরোনাম ছিল ‘আমরা সব জানি।’ এ ছাড়া তাঁর মন্তব্যে আরো ছিল ‘পথভ্রষ্ট তরুণদের সংখ্যা বেশি নয়। আমরা জানি তারা কারা ও কোথায় অবস্থান করছে।’ তবে সাবধানের মার নেই। কারণ এরও কিছুদিন আগে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে জঙ্গিরা প্রায়ই কৌশল বদলাচ্ছে। এ ধরনের উক্তির পর তারা হয়তো আরো বেশি পাল্টা কৌশল অবলম্বন করবে। ১৯ জুলাই প্রকাশিত এক সংবাদে পুলিশের অধিকতর সতর্কতার বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল। এতে বলা হয় যে আগাম তথ্যে জঙ্গিদের আরো বেশি তৎপরতা রয়েছে, যার জন্য পুলিশের ছুটি দেওয়া বন্ধ করা হয়। এ বিষয়ে ২৩ জুলাইয়ের এক সংবাদে দেখা যায় যে রাজশাহীতে জঙ্গিদের আক্রমণ নস্যাৎ করা হয়েছে। এর আগে গুলশানের ঘটনার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতেই পুলিশ ও র‍্যাব ধারণা করে যে তাদের অনেকেরই জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শুরু হয় দেশব্যাপী নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়ন। সবার আগে র‍্যাব ২৬২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করে।
পুলিশের থানাসহ অন্যান্য উেসর ভিত্তিতেই এ তালিকা প্রণীত হয়। বলা বাহুল্য, তালিকা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। কারণ এ নিয়ে বিপরীতধর্মী কিছু তথ্যও মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। শেষ পর্যন্ত র‍্যাবের তালিকা সংশোধন করে নিখোঁজের সংখ্যা ৬৮ জন বলা হয়। তবে এটাও হালনাগাদ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে যা বলা যায় তা হলো, এ ধরনের তালিকা কখনো চূড়ান্ত হবে না। সংখ্যা বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে। এ বিষয়ে যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো, নিখোঁজের বিষয়ে পুলিশকে অতীতের উদাসীনতা পরিহার করে অর্থবহ অনুসন্ধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যথায় জঙ্গিদের বিষয়ে আগাম তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছাত্র নিয়েই নিখোঁজ সংবাদ সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। অনেকে এ কথাও বলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়নি। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী কেউ দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে তার নাম কেটে দেওয়া হয়। অনেকেই নানা কারণে পড়াশোনা আর চালায় না। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের অভাব। অনুপস্থিত থাকা মানেই নিখোঁজ বা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা নয়।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশংসনীয় সাফল্য ছিল কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযান। এ অভিযানের আগাম তথ্য রাকিবুল নামে এক আহত জঙ্গি পুলিশকে দিয়েছে। তাকে রাত দেড়টায় গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর জঙ্গিদের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হয়। পুলিশের এ বিষয়ে আরো তথ্য ছিল যে রাকিব এক বছর আগে আইএসে যোগদান করে। অন্যদিকে পুলিশপ্রধানের বক্তব্য ছিল, এ অভিযানে ৯ জন নিহত জঙ্গি ও একজন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কোনো আইএস-সংশ্লিষ্টতা নেই। আইএসের বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। তবে কালো পতাকা ও অন্যান্য সামগ্রী থেকে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে আইএসের সঙ্গে কিছু না কিছু যোগসূত্র রয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মানিকগঞ্জের চর এলাকায় পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযান পরিচালিত হয়। এর ফলে প্রকাশিত তথ্যমতে, আটজন ‘সন্দেহভাজন’ জঙ্গিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অভিযানের আগে বগুড়ার চরাঞ্চলে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি জঙ্গিবিরোধী অভিযান সম্পন্ন করে। দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা স্থায়ী এ অভিযানে ৯টি জিহাদি বই ও ছয়টি ধারালো অস্ত্র জব্দ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা বন্ধ করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর ফলে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণাসহ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। তবে এর মূল কারণ জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা নয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়মের তদন্ত করে এক বিচার বিভাগীয় কমিশনের সুপারিশেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলসহ জেলা প্রশাসকদেরও জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় পার্টিতে উপস্থিত দলীয় সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জঙ্গিবিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়। অন্যদিকে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও জঙ্গিবিরোধী প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর ১৯টি করণীয় ক্ষেত্রের মধ্যে এ বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ছোট-বড় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনগুলো এখন সরব। ঢাকার বাইরেও একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে। এরই মধ্যে সামাজিক অঙ্গনে যে গতি সৃষ্টি হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে।
দুটি বিষয় এখনো গতিশীল নয়। এক. গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিরা জামিনে মুক্ত এবং দুই. তাদের কর্মকাণ্ড ও সংগঠন পরিচালনার অর্থের উৎস কারো কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। একটি দৈনিকের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে গত কয়েক বছরে প্রায় ৫০০ বিচারাধীন জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। তাদের অনেককেই এখনো ধরা হয়নি। জামিনে মুক্ত যেকোনো অপরাধী আদালত নির্ধারিত পরবর্তী শুনানিতে হাজির না থাকলে জামিন বাতিল হওয়ার কথা। যে দৈনিকে এ সংবাদ প্রকাশ করা হয় তার প্রতিবেদনের মন্তব্য অনুযায়ী জঙ্গিদের সহজে জামিন পাওয়ার জন্য তদন্তকারী সংস্থাসহ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত উকিলরাই দায়ী। তদন্তকারী সংস্থা যদি আদালতে যুক্তি স্থাপনের জন্য গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আদালত উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে জামিনের আদেশ দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে সরকার নিযুক্ত পিপি ও এপিপি যদি যথাযোগ্য আইনি জ্ঞানের অধিকারী না হন, তাহলে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য যুক্তি হবে না। এ দুটি ক্ষেত্রের দুর্বলতার বিষয়ে অতীতে সেমিনারসহ মিডিয়ায় বহু কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো উন্নতি হয়নি। জঙ্গি দমন অভিযানের এ দুর্বলতা পরিহার না করতে পারলে ঈপ্সিত ফল অর্জন করা যাবে না। কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি চ্যানেলে একই বিষয়ে শায়খ আবদুর রহমানসহ অন্যদের মামলার বিষয় উল্লেখ করা হয়। জয়পুরহাটে প্রায় ১৮-১৯ জন গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়ে এখন সক্রিয় হয়েছে। জঙ্গি কর্মকাণ্ডজনিত মামলায় সহজে জামিন পাওয়ার বিষয়টি প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি দৈনিকে সম্পাদকীয় মন্তব্যও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো সরকারি উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা হয়নি। যা হয়েছে তা হলো, এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব গ্রহণের বাণী। তবে দুদিন আগে আইনমন্ত্রী এ বিষয়টি ডিসিদের পরিবীক্ষণ করে তাঁর মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলেছেন। এই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা সম্পর্কে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
চলমান জঙ্গিবিরোধী দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো, এ গোষ্ঠীর অর্থের উৎস সন্ধান। ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়েও এ নিয়ে অনেক উদ্যোগ গ্রহণের কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে সুফল অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ে ধারণা ছিল জঙ্গিগোষ্ঠীর অর্থের উৎস বাংলাদেশের বাইরে। বাইরের কিছু রাষ্ট্র থেকে অর্থ জোগান দেওয়া হয়। এ বিষয়টির গ্রহণযোগ্য প্রমাণ না পাওয়া গেলে কোনো মামলাও করা সম্ভব নয়। এর ঠিক বিপরীতধর্মী চিত্র পাওয়া যায় এশিয়ার অন্য একটি দেশের এ ক্ষেত্রে সাফল্য। কিছু দিন আগে সিঙ্গাপুরের এক আদালত জঙ্গিদের জন্য অর্থ জোগান দেওয়ার একটি মামলায় কয়েকজন বাংলাদেশিকে অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করেছে। অন্য কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এখন যা শোনা যাচ্ছে তা হলো, দুর্নীতির অর্থই জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। দুদক এ বিষয়টি তদন্তের আওতায় আনবে বলে জানা গেছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা