ড. সুলতান মাহমুদ রানা । খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট ২০১৬: সন্তান জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই অভিভাবকরা শিশুসন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কোন প্রতিষ্ঠানে তাঁর সন্তানকে ভর্তি করাবে, কোথায় পড়াশোনা করাবে—এসব বিষয়ে ভাবনার শেষ থাকে না। ওই শিশুটি যতই বেড়ে ওঠে অভিভাবকের স্বপ্ন ও শিশুর প্রতিযোগিতার পরিমাণও ততই বাড়তে থাকে। এমন অবস্থা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না বললেই চলে। জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায়ই বসতে হয় না শিশুদের। সেখানে শুধু শিক্ষা দেওয়া হয় কিন্তু পরীক্ষাভীতি থেকে মুক্ত রাখা হয় শিশুকে। মূলত শিশুর মানসিক বিকাশকেই মুখ্য বিবেচনা করা হয়।
কয়েক বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ভালো ফল করছে। এ বছরও উচ্চ মাধ্যমিকে যথেষ্ট ভালো ফল হয়েছে। বিশেষ করে গত বছরের তুলনায় বেশ ভালো। আর এই ভালো ফলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, প্রত্যাশার পরিমাণও অনেক গুণ বাড়ছে। স্বপ্ন দেখা অন্যায্য কিংবা দোষের কিছু নয়। সবারই স্বপ্ন দেখা ও প্রত্যাশা করার ন্যায্য অধিকার রয়েছে।
উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ ও করণীয় নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সবাই বেশ চিন্তিত। কারণ প্রথম সারির উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় একটি আসন পেতে একজন শিক্ষার্থীকে অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে এ বছরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকটের কারণে জিপিএ ৫ পেয়েও ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তির সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ‘অদ্ভুত’ সব নিয়ম তৈরি করেছে পদ্ধতিগত জটিলতা। এসব কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বিপাকে পড়তে হয় ভর্তীচ্ছু মেধাবী শিক্ষার্থীদের। অবশ্য এ জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধরন এবং এর বাস্তবমুখী প্রয়োগ ও সুযোগের পদ্ধতিগত দিককে অনেকাংশে দায়ী মনে করা যায়।
সাধারণত যেসব শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ ৫ পায়, তারা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে কোনো একটিতে জায়গা করে নিতে চায়। এ প্রত্যাশা অমূলক নয়। কিন্তু উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া এসব শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে ভালো বা কাক্সিক্ষত বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। শুধু তাই নয়, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিমাণে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যদিও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংকট অনেকটা লাঘব হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুসারে বর্তমানে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট ১২৮টি বিশ্ববিদ্যালয়, যা সংখ্যার দিক থেকে যথেষ্ট মনে হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ভিন্ন মাত্রার সমস্যা যোগ হয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে দেশের নামিদামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেলেও এবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভীতি তৈরি হয়েছে যথেষ্ট। এ ছাড়া ইতিমধ্যেই ইউজিসি ১১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে সতর্কতা দিয়েছে। খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই বোঝা যাচ্ছে, এ বছর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর নজর থাকবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কিন্তু পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর হার বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকট বিদ্যমান রয়েছে।
এর পরও অনেক মেধাবীই কাক্সিক্ষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করবে। সাধারণত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ম হয় আরো অনেক বড় বড় স্বপ্ন। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী তার স্বপ্নগুলো লালনের মধ্য দিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করে। তার পরই শুরু হয় শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। সেটি হলো কাক্সিক্ষত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে যথাযথভাবে বিজয়ী হলেই শুধু তার প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় ঘটে। কিন্তু কত শতাংশ শিক্ষার্থী তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়? সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের যুবসমাজের ৯.১ শতাংশ বেকার। মূলত ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই হারে বেকার আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ যুবক-যুবতী। এ তথ্য থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী অনেক তরুণ-তরুণীই কাজের অভাবে রয়েছে, যা প্রত্যাশাপ্রাপ্তির পথে একটি বড় অন্তরায়।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় না হওয়ার বিষয়টি সবার মনে একটি প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে যে এই সমন্বয়হীনতার জন্য শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা, নাকি দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা? যখন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী তার মেধার যথাযথ ও কাক্সিক্ষত মর্যাদা পায় না তখন সে এ জাতির জন্য কতটুকুই বা কল্যাণকর হতে পারে? শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় না ঘটলে সেখানে সৃষ্টি হয় চরম হতাশা। আর এমন হতাশাই সৃষ্টি করে সমাজে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[সংকলিত]