খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী:
প্রাচীন গ্রিক বা এথেনিয়ান সিটি স্টেটের যুগে পেরিক্লিয়াস একটি সিটি স্টেটের প্রভাবশালী রাজা ছিলেন। গ্রিক ইতিহাসে তিনি এখনো একটি স্মরণীয় নাম। এই পেরিক্লিয়াসের বিচার পদ্ধতি ছিল অদ্ভুত।
তিনি দুষ্কৃতীদের যে সাজা দিতেন, তার চেয়ে বেশি শাস্তি দিতেন তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতাদের। তাঁর যুক্তি ছিল, বেশির ভাগ অপরাধী অপরাধ করে ক্ষণিকের উত্তেজনা, লোভ বা ক্রোধের বশে। কিন্তু তাদের যারা আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয় তারা কাজটি করে ঠাণ্ডা মাথায় এবং আরো বড় অসৎ উদ্দেশ্যে। তাদেরও তাই সাজা হওয়া উচিত এবং সেই সাজা হওয়া উচিত আরো কঠোর।
প্রাচীন পেরিক্লিয়াস যুগের এই নীতিটি বাংলাদেশেও অনুসৃত হওয়া উচিত বলে মনে করি। একাত্তরের আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের প্রাণদণ্ডের রায় কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানের বড় পর্বটিও শেষ হয়েছে বলা চলে।
আর যারা বিচারাধীন আছে তারা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, একমাত্র দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছাড়া। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার আদালতের এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান সম্পর্কে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে জাতির কাছে যে অঙ্গীকার করেছিলেন, সেই অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। কিন্তু জাতির কাছে এই সরকারের আরো একটি বড় দায় রয়ে গেছে। সেটা হলো জাতির মানসকে কলঙ্কমুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে জাতির জীবনকে কলুষমুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া।
জাতির জীবনকে কলঙ্কিত করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা। সেই কলঙ্ককে দীর্ঘকাল আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে জাতির জীবনকে কলুষিত ও অভিশপ্ত করে রেখেছে তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতারা। মানবতার জঘন্য শত্রুদের বিচার হওয়ার পর তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবকদেরও বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত।
নইলে তাদের ছড়িয়ে রাখা কলুষ থেকে জাতির আর্থসামাজিক জীবন স্থায়ীভাবে মুক্ত হবে না। আর তা যদি না হয়, তাহলে শুধু একাত্তরের শীর্ষ ঘাতকদের বিচার ও দণ্ড দ্বারা এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন করা যাবে না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পরাজিত ফ্যাসিস্ট নেতাদের অধিকাংশকে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের মামলায় প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই প্রাণদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের এক বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমরা শুধু কয়েকজন অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু এই অপরাধের উৎসমুখ বন্ধ করতে পারিনি।
এই উৎসমুখ হলো মানবতাবিরোধী ফ্যাসিবাদ। এই ফ্যাসিবাদে যারা বিশ্বাসী, ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানে সহায়তা দানকারী ও ফ্যাসিস্টদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা, তাদের আমরা শাস্তি দিতে পারিনি। স্বাধীন বিশ্বের গণতান্ত্রিক নেতাদের উচিত হবে এই ফ্যাসিজম ও ফ্যাসিস্টদের পেট্রনদের খুঁজে বের করা এবং শাস্তি দেওয়া। নইলে ফ্যাসিবাদ আবার মাথা তুলবে এবং গণতন্ত্র ও মানবতাকে আবার বিপন্ন করবে।’
এই বিচারপতির মন্তব্য যে কত সঠিক ছিল, তা বর্তমান ইউরোপের ফ্রান্স ও জার্মানি, এমনকি আমেরিকায় নব্য নািসদের আবির্ভাব ও শক্তিশালী হয়ে ওঠা থেকে বোঝা যায়। বাংলাদেশেও একাত্তরের পরাজিত মানবতা ও স্বাধীনতার শত্রুদের যদি সঙ্গে সঙ্গে বিচার ও দণ্ড দেওয়া যেত এবং সেই সঙ্গে তাদের পেট্রনদেরও বিচার হতো, তাহলে পরবর্তীকালের বহু অঘটন থেকে বাংলাদেশ বেঁচে যেত।
দীর্ঘ চার দশক পর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচার হয়েছে বটে; কিন্তু তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতারা এখনো আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয়। বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন হয়নি। তা থেকে আবার মহীরুহ গজাতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কোলাবরেটর আইনে স্বাধীনতা ও মানবতার শত্রুদের বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের সেই সরকার এই বিচার শেষ করে যেতে পারেনি। দেশে প্রতিবিপ্লব ঘটে এবং স্বাধীনতার শত্রুদের পেট্রনরা ক্ষমতা দখল করে। তারপর শুরু হয় মানবতা ও স্বাধীনতার এই শত্রুদের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে পুনর্বাসন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের শীর্ষ শত্রু যারা পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল তাদের ডেকে এনে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে যা ঘটেনি, বাংলাদেশে তা ঘটেছে। ফ্রান্সে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বারবার ক্ষমতার হাতবদল ঘটেছে; কিন্তু কোনো দল নািসদের কোনো কোলাবরেটর বা তাদের দলকে ক্ষমতার অংশীদার করেনি, যেটা বাংলাদেশে করেছে বিএনপির জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সরকার।
জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাযুদ্ধের শত্রু এবং পাকিস্তানি হানাদারদের কোলাবরেটর, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিরোধিতা করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে জাতিসংঘে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, সেই শাহ আজিজুর রহমানকে তাঁর সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে বসান।
যুদ্ধাপরাধীদের শীর্ষ নেতা পাকিস্তানে পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ডেকে এনে জামায়াতের আমির পদে বসতে দেন এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের বাড়বাড়ন্তির মূলে রয়েছে জিয়াউর রহমানের ম“ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
স্বাধীনতার শত্রু ও ঘাতক-দালালচক্রকে ম“ ও আশ্রয়দানের ব্যাপারে স্বামী জিয়াউর রহমানের রেকর্ড ভেঙেছেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনি ক্ষমতার লোভে শুধু জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করেননি; মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদের মতো স্বাধীনতার চিহ্নিত শত্রু ও ঘাতকদের এনে মন্ত্রী পদে বসিয়ে তাঁদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দিয়ে এই পতাকার চরম অবমাননা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা ছিল সর্বজনবিদিত, তাঁকে এনে খালেদা জিয়া শুধু দলের বড় নেতা নয়, মন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন। তাঁকে ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল করতে চেয়েছিলেন।
বিএনপি মানবতার জঘন্য শত্রুদের শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসায়নি, দেশের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য জামায়াতকে তার সন্ত্রাসী রাজনীতিতে ম“ জোগায়। এমনকি তাদের সন্ত্রাসে সহযোগী হয়। বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়েই ধ্বংসাত্মক উগ্র মৌলবাদ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানদের আবির্ভাব ঘটে। জামায়াতের গর্ভে জন্ম নেয় জেএমবি, আনসারুল্লাহ, হিযবুত তাহ্রীর ইত্যাদি অসংখ্য ঘাতক দল। শুরু হয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, পরবর্তীকালে ব্লগার হত্যা, রেস্তোরাঁয় গণহত্যা। ২০০৪ সালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাও চালানো হয় বিএনপির শাসনামলে এবং তাদের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সহযোগিতায়ই।
জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ—দুজনই বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ছিলেন ফ্যাসিস্ট চরিত্রের সামরিক শাসক। তাঁদের শাসনামলে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ প্রশ্রয় ও আশ্রয় পাবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এই দুই সামরিক শাসকের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বাংলাদেশে মানবতার শত্রুরা আবার মাথা তুলতে পেরেছে এবং শক্তিশালী হয়েছে। জিয়াউর রহমান যদি জাতির পিতাসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের হত্যার সঙ্গে জড়িত হয়ে থাকেন, তাহলে জেনারেল এরশাদকে দায়ী করা যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সেই চেতনাভিত্তিক সংবিধানকে হত্যা করার জন্য।
সংবিধানে নিজের খেয়ালখুশিমতো রাষ্ট্রধর্মের বিধান ঢুকিয়ে এরশাদ গোটা মুক্তিযুদ্ধের বুনিয়াদকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। তিনি স্বাধীনতার শত্রুদেরও একজন বড় প্রশ্রয়দাতা ছিলেন। দৈনিক ইনকিলাবের মালিক মাওলানা মান্নান ছিলেন একাত্তরের একজন ঘাতক ও দালাল।
জেনারেল এরশাদ তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দেন এবং বঙ্গবন্ধুর ঘাতক কর্নেল (অব.) ফারুককে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ ও অনুমতি দিয়েছিলেন।
আজ যে বাংলাদেশে জামায়াত ও অন্যান্য সন্ত্রাস এমন ভয়াবহভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা এমনি এমনি হয়নি।
হয়েছে একদল ক্ষমতালোভী মানুষ ও দলের দেশপ্রেমবর্জিত কার্যকলাপে। তারা এখনো দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। সন্ত্রাসীচক্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখনো অবিচ্ছিন্ন। কেবল একাত্তরের কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ঘাতককেই দণ্ডদান করে রাষ্ট্রশক্তি শান্ত হলে এই বিষবৃক্ষ নির্মূল হবে না। এর শিকড় এখন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ এখন নানা চেহারায় আবির্ভূত এবং সক্রিয়। নিজামী-মীর কাসেমদের দণ্ডিত হওয়া প্রয়োজন ছিল।
তা দেশের ঘাতক ও সন্ত্রাসীচক্রকে কিছুকালের জন্য নিরুৎসাহ করবে। কিন্তু তারা পুরনো ও নতুন পেট্রনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আবার সংঘবদ্ধ হবে। নতুনভাবে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে আঘাত হানার জন্য তৎপর হবে। এই মহা-আশঙ্কা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য ধ্বংসাত্মক শক্তির এই অভিভাবক ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে সরকারকে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তৃতায় আভাস দিয়েছেন, ‘দেশে জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও রেহাই দেওয়া হবে না।’ এটা যেন প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা না হয়ে মনের কথা হয়। তিনি যখন কঠোর হয়েছেন তখন আরো কঠোর হোন।
দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক শক্তির যারা আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা তারা তাঁর চোখের সামনেই এখনো নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে; গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে মায়াকান্না কেঁদে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হোন। জনগণের কাছে তাদের মুখোশ খুলে ধরুন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো যুদ্ধাপরাধীদের অভিভাবকদেরও বিচারের ব্যবস্থা করুন। নইলে দেশ বিপদমুক্ত হবে না।