আহমদ রফিক ।। খোলা বাজার২৪, রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬ : বলতে হয়, এ লজ্জা রাখি কোথায়? মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের পবিত্র ভূমিতে বিদেশি গৃহকর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতন। ঘটনা আজকের নয়, অনেক দিনের, অন্তত কয়েক দশক আগেকার। কয়েকটি ঘটনার সুবাদে রাষ্ট্র্রিক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ চেয়ে গোটা দুই নিবন্ধ লিখেছিলাম দৈনিকের উপসম্পাদকীয় পাতায়। বিশেষত যাতে সৌদি আরব, কুয়েত প্রভৃতি দেশে নারী শ্রমিক পাঠানো নিষিদ্ধ করা হয়। কোনো দিকেই কিছু হয়নি।
না বন্ধ হয়েছে অসহায় বাংলাদেশি নারীর ওপর যৌন নির্যাতন, না বাংলাদেশের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে কোনো ব্যবস্থা। যেন এরা সব গনিমতের সম্পত্তি। আর বলিহারি বাংলাদেশি নারীদের। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরও অর্থ উপার্জনের টানে তাদের মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা বন্ধ হয়নি। এই তো কয়েক দিন আগে রাজধানী ঢাকায় এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দেখা গেল কয়েক শ বাংলাদেশি নারীর ভিড়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষাদির জন্য। বিদেশযাত্রায় যা আবশ্যিক। বোরকা-হিজাব সব ঠিকঠাক আছে, যার মর্যাদা দেশ বিশেষে লুণ্ঠিত।
এ ব্যাপারে আবারও একটি দৈনিকের শিরোনাম ‘সৌদিতে যৌন নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকরা।’ এসব শিরোনাম উপেক্ষার হাওয়ায় উড়ে যেতে দেখা গেছে একাধিকবার। দেখা যাক, এবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের টনক নড়ে কি না। কারণ পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ, এবার সৌদি আরব সফর শেষে আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী সেখানকার বাংলাদেশি নারী শ্রমিক ও গৃহকর্মীদের মুখে যৌন নির্যাতনের কাহিনী শুনে হতবাক হয়ে গেছেন। তিনি নাকি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। কপি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে।
মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ বিশেষভাবে রাজতন্ত্রী, শেখতন্ত্রী দেশগুলোর মধ্যযুগীয় চরিত্র যে আধুনিক যুগেও দিব্যি বিনা প্রতিবাদে বহাল আছে, তা আপাত বিচারে অভাবিত মনে হলেও আসলেই তা বাস্তব ঘটনা। তাদের শাসন পরিচালনা যত অনাধুনিকই হোক, পেট্রোডলারের দাক্ষিণ্যে এবং ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আধুনিক দেশগুলোর সক্রিয় সমর্থনে তারা বহাল তবিয়তে আছে।
সবচেয়ে মজার ঘটনা হলো, সেখানকার সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক শিক্ষা এমনই পর্যায়ে যে কোনো অমানবিক বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডেরই প্রতিবাদ লক্ষ করা যায় না। নাগরিকদের মানসিকতাও মধ্যযুগীয়। আধুনিক শিক্ষার আলোকপ্রাপ্তদের সংখ্যা এত কম যে তাদের কোনো সামাজিক প্রভাব নেই। রক্ষণশীলতা ও আইনকানুনের শৃঙ্খল এতই কঠিন যে প্রতিবাদ উচ্চারণের সুযোগ নেই বললেই চলে। স্মরণযোগ্য, বহুকাল আগে সৌদি পরিবারের এক স্বাধীনচেতা নারীর প্রেম ও মৃত্যু নিয়ে ব্রিটেনে তৈরি হয়েছিল একটি ছায়াছবি—‘ডেথ অব এ প্রিন্সেস’। গোটা বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছিল ছবিটির করুণ মর্মবস্তু।
কিন্তু এতকাল পরেও ওই শাসনযন্ত্রের অচলায়তনে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। চলছে সেই মধ্যযুগীয় শিরñেদ প্রথা, যৌন অনাচার ইত্যাদি। এতে আপত্তি নেই গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী ইউরোপীয় দেশগুলোর, বিশেষ করে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি আধুনিক চেতনার রাষ্ট্রগুলোর—গণতন্ত্র নিয়ে যাদের এত বড়াই। কারণ একটাই—অর্থনৈতিক স্বার্থ। তাই চোখ বন্ধ করে রাজনৈতিক সমর্থন জারি রাখতে হয়।
দুই.
মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বোক্ত কয়েকটি দেশে যৌন অনাচার এত বেশি যে তা চোখে না পড়ে পারে না। তবু ওই যে আগে বলেছি, পবিত্র ভূমি বলে কথা। সেখানে কোনো অনাচার ঘটতে পারে না। আর ঘটলেও তাতে বোধ হয় দোষ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ-জাতীয় যৌন অনাচার বা নির্যাতন ঘটছে বিদেশিদের ওপর, নিম্নবর্গীয় নারীদের ওপর, যাদের প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই বা প্রতিবাদ করলেও তা শোনার মতো কেউ নেই তাদের দেশে বা বিদেশে।
তাই অত্যাচারিত হয়েও ওই সব অসহায় নারীকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয় অথবা চেষ্টা-চরিত্র করে স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসতে হয় জীবনের সচ্ছলতার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে। কারণ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে কোনো সুবিচার মেলে না। বরং অভিযোগের দায়ে অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়ে। তাই সহ্য করার কোনো বিকল্প পথ খোলা থাকে না।
আর এ কারণে অনেক দেশই সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আর তাই বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক আমদানিতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখা যাচ্ছে সৌদি সরকারের, পুরুষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ নেই তাদের। আশ্চর্য যে এসব ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা বা সম্ভ্রম রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ববোধ প্রখর নয়।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত পহেলা সারিতে, এক নম্বরে। এরপর ব্রিটেন ও প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলো বিদেশে তাদের নাগরিকদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক এবং ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয়। বহু ঘটনা তার প্রমাণ। এদিক থেকে চীন, জাপানও যথেষ্ট সচেতন। ব্যতিক্রম কি শুধু বাংলাদেশ! মার্কিনি সংস্কৃতির ভালো দিকগুলো সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ যথেষ্ট নয়, যেমনটা রয়েছে মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে।
উল্লিখিত পরিস্থিতি বিবেচনায় সাবের হোসেন চৌধুরী নাকি বলেছেন, ‘সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা অনেক। সৌদিতে নিরাপদ কর্মসুবিধা পেতে শ্রমিকরা নিজেদের সহায়সম্বল বিক্রি করে যে পরিমাণ টাকা দালালদের দেয়, সে অনুপাতে শ্রমিকদের আয় বিবেচনা করলে তার কোনো মানেই হয় না। এত টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যাওয়ার চেয়ে তা দেশেই বিনিয়োগ করে এখানেই থেকে যাওয়া ভালো মনে হয়।’ এটা অবশ্য অন্য এক ইস্যু, যা বিদেশে কর্মসংস্থানে সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
বিষয়টি সম্পর্কে সাবের হোসেন চৌধুরীর বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন বাস্তবধর্মী বলেই মনে হয়। বাস্তবিকই অবস্থা বিবেচনায় সৌদি সোনার হরিণের পেছনে ছোটা বেশির ভাগ অশিক্ষিত শ্রমিকের জন্যই আত্মঘাতী পদক্ষেপ। আর নারীদের ক্ষেত্রে তা আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার শামিল। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে অবিবেচকের পদক্ষেপই নিচ্ছে সৌদি আরবের যাত্রী নিম্নবর্গীয় কর্মপ্রার্থীরা, বিশেষত নারী শ্র্রমিকরা।
বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কম নয়। তারা তাদের দায়িত্ব অসৎ দালালদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। আর দালালরা গুচ্ছের টাকা আত্মসাৎ করে বাংলাদেশি নাগরিকদের চাকরির নামে নিরাপত্তাহীন অনিশ্চয়তার মরুবালিতে ছুড়ে দিচ্ছে। এ অন্যায় অনাচারের কোনো প্রতিকার নেই, কী স্বদেশে কী বিদেশে। নিম্নবর্গীয় মানুষের এমনই পোড়া কপাল।
আমাদের দাবি বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশেষ করে অদক্ষ ও অশিক্ষিত কর্মীদের ক্ষেত্রে সরকারকে জনবান্ধব নিয়মনীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশযাত্রী কর্মীদের অমানুষ দালালদের হাতে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। চাকরি সম্পর্কে বিশদ তথ্য, প্রার্থীর যোগ্যতা ইত্যাদি তথ্য-উপাত্তের নিশ্চয়তার ভিত্তিতে চাকরিপ্রার্থীদের বিদেশযাত্রা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ব্যাপারে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস কূটনৈতিক মিশনগুলোকেও দায়িত্ব নিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া মোটেই কঠিন নয়। অর্থলালসা তথা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পিছে ছুটে নিম্নবর্গীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের দুর্ভোগের শিকার হতে না দেওয়ার দায়দায়িত্ব সরকারের আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের।
রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে, সেই সুবাদে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে হলে তার বিপরীতে জনস্বার্থের পক্ষে কিছু দায়িত্ব অবশ্যই সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পালন করতে হবে। এটা রাজনীতির লেনদেনের অলিখিত নিয়ম। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এসব বিধিবিধানের পথ ধরেই চলতে হবে এবং তা সুষ্ঠু নিয়মনীতির মাধ্যমে। দেশ শাসন করতে হলে দেশবাসীর ভালোমন্দের দায়ও নিতে হবে। সবশেষে একটি কথা, অবস্থাদৃষ্টে নিম্নবর্গীয় নারী শ্রমিকদের সৌদি যাত্রা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হোক, যাতে অবিলম্বে এ সর্বনাশা যাত্রা বন্ধ হয় এবং নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
[সংকলিত]