খোলা বাজার২৪, রবিবার, ৮ জানুয়ারি ২০১৭: সৈয়দ আবুল হোসেন
আমাদের দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের প্রধান নারী। প্রধানমন্ত্রীও নারী।
বিরোধী দলের নেতাও নারী। অন্য একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধানও নারী। তিনিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। স্পিকারও নারী। বাকি আছে একজন নারী রাষ্ট্রপতি করার। সেটাও হয়তো যেকোনো সময় হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখন সচিব, বিচারপতিও নারী আছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে নারীরা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশেও নারীরা ভালো করছে। একটা সময় এ অবস্থা ছিল না। অনেক কষ্ট করেই আমাদের এখানে আসতে হয়েছে। আমাদের সমাজের নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে অনেকেই বিস্মিত হয়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয় বিদেশে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীর যথাযথ মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন। অতীতের কোনো সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিক ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মূল্যায়নে এমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন নারীর ক্ষমতায়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছেন। এর পরেরবার ক্যাবিনেট এবং একসময় স্পিকার হিসেবে নারীর যোগ্যতার প্রমাণ তুলে ধরলেন। নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘গ্ল্যামার’-এর বিচারে বর্ষসেরা নারী মনোনীত হয়েছেন শেখ হাসিনা।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ হাসিনার সরকার নারী উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫), যেখানে জাতীয় ও মাঝারি পর্যায়ের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ২০২১ সাল (ভিশন-২০২১ নামেও পরিচিত) নাগাদ একটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলায় অঙ্গীকারবদ্ধ, নারীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করাকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রধানতম চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। শেখ হাসিনা নারীর কার্যকর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোগ, মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১, নারীর প্রতি সহিংসতা দমন, অকাল ও বাল্যবিবাহের সমাপ্তি, রাজনীতি, প্রশাসন, নিরাপত্তা প্রভৃতিতে নারীরা উল্লেখযোগ্য।
লিঙ্গ-সমতা স্থাপনের অন্যতম নিয়ামক রাজনৈতিক ক্ষমতায় নারী-পুরুষের আনুপাতিক অবস্থান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে সৃষ্টি করেছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশ্ব আর্থনীতিক ফোরাম প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৩ অনুযায়ী ১৩৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, যা ১০ বছরে এগিয়েছে ১১ ধাপ। অন্যদিকে শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশের স্থান পৃথিবীর মধ্যে অষ্টম, যা ১৯৯১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে দুই নেত্রীর রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা এবং সংসদে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০ শতাংশে পৌঁছানোর কারণে সম্ভব হয়েছে।
অবশ্যই সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, নারীরা তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠন করছে এবং বলিষ্ঠ ও শিক্ষিত এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলছে, যারা দেশকে ভালোবাসে, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জানে, উন্নয়নপ্রক্রিয়া ও নির্মাণকাজ চালিয়ে নিতে পারে, সর্বোপরি সহায়তা দিচ্ছে একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে।
আমি আগেও বলেছি, নারীরা হচ্ছে দেশের আত্মা ও শক্তি। এর অর্থ হচ্ছে, একজন নারীর রয়েছে আবেগময় বোধশক্তি, দয়ালু হূদয়, উদার মন, প্রবল উচ্চাকাক্সক্ষা এবং দূরদর্শী মূল্যবোধ। বাংলাদেশের নারীরা দেশের জীবনযাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত এবং তারা আমাদের সমাজে মূল সংস্কৃতিকে ধারণ করে, যা অনেক মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। মা-বোন ছাড়া কোনো ব্যক্তি কি বাঁচতে পারে? মেয়ে অথবা স্ত্রীর স্নেহ-মমতা ছাড়া কোনো ঘর কি চিন্তা করা যায়? নারী ছাড়া কোনো সমাজ কি এগিয়ে যেতে পারে? সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নারীদের কী ভূমিকা তা অনুধাবনের জন্য অমর্ত্য সেনের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। অমর্ত্য সেনের মতে, নানা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষে অভাবনীয় আর্থিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে মূলত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির জন্য। ‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি, ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কন্ট্রাডিশন্স’ (২০১৩) প্রবন্ধে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশের বেগবান নারী আন্দোলন, সক্রিয় এনজিও কার্যক্রম ও পেইচিং-পরবর্তী বিশ্ব নারী উন্নয়ন এজেন্ডার প্রভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর কৌশলের লক্ষ্যে যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে বাংলার নারীজীবনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা ঘটে, যাকে বিশ্বব্যাংক আখ্যা দিয়েছে ‘হুইসপার টু ভয়েসেস’ (২০০৮)।
সুতরাং এটি সহজে অনুমেয় যে নারীরা আমাদের সমাজের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের আসন এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। আজ আমরা যে অবস্থানে আছি, এ অবস্থানে কখনো আসতে পারতাম না, যদি না থাকত নারীদের অবদান। আমাদের আত্মবিশ্বাসী, উচ্চাকাক্সক্ষী ও বিশ্বাসী মা-বোনদের অনেক অবদান রয়েছে বাংলাদেশের এ অবস্থানে আসার পেছনে। আমাদের বোনেরা দৃঢ়চেতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠাবতী, উন্নয়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধেও আমাদের নারীদের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
আমরা আধুনিক ও প্রাচীন ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাব, মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন বহু মানুষ এবং বহু নারীর নামও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে তাঁদের নিজেদের কৃতিত্বে। নারীদের বহু অবদান আছে বদান্যতায়, মহত্ত্বে এবং দানশীলতায়। মনে পড়ে বেগম রোকেয়ার কথা। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে বাংলার নারী জাগরণের সূচনায় যাঁদের অনবদ্য অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতে হয় তাঁদের মধ্যে সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সম-অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে এনজিওভিত্তিক নারী আন্দোলনের বিশাল ক্ষেত্র উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব নেত্রীবর্গের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, রানি ভিক্টোরিয়া, জোয়ান অব আর্ক, অ্যান ফ্রাংক, মার্গারেট থ্যাচারসহ আরো অনেকের কথা বলা যায়।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম পর্যায় ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা। আশির দশকে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা চরম দারিদ্র্য মোকাবিলা করে উপার্জনের পথ খুঁজে পায়। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক ও অন্যান্য এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ২৬ মিলিয়নের মতো দরিদ্র মানুষ উন্নয়নের পথ খুঁজে পায়। এ ঋণগ্রহীতাদের ৯৭ শতাংশের বেশি নারী, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাসের বার্ষিক হার ১.৭ শতাংশে নেমে আসে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সংগত কারণে বাংলাদেশের আর্থিক সমৃদ্ধিতে জাতি বহুলাংশে নারীদের কাছে ঋণী।
আমরা এরই মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে ফেলেছি। আমরা আমাদের সমাজকে ক্ষমতায়ন করেছি, আর এই সমাজের মাধ্যমে নারীরাও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে।
আমাদের দায়িত্ব নারীদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া, যাতে তারা তাদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। অন্য কথায়, বৃষ্টির পানিতে ভালো ফসল ফলাতে হলে অবশ্যই মাটির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কাজের এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে নারীরা ইজ্জত, সম্ভ্রম ও নারীত্ব বজায় রেখে তাদের সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে পারে। মেধার মূল্যায়ন, সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং তাদের জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।
এ রকম পরিবেশ দিতে পারলে, আমি বিশ্বাস করি যে নারীরা সব কিছুই করতে সক্ষম হবে। এটা অলৌকিক কিছু নয়—এটাই বাস্তবতা। নারীরা সাধারণত কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রফেশনাল। তাই কোনো কাজে তারা যত আন্তরিক পুরুষরা তত আন্তরিক হতে পারে না। তাদের এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।